Wednesday, 8 June 2016

শিশু মন

সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে ছুটে ছুটে বাস ধরি ভিড় বাসে বসার জায়গা খুঁজি। ট্রাফিকে পড়ে পনের মিনিটের রাস্তা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে অতিক্রম করে, শেষে বাস থেকে নামার সময় কন্ট্রাক্টরের সাথে টাকা ফেরত নেওয়া  নিয়ে এক চোট হাওয়ার পর শেষমেশ বাস থেকে নেমে পড়লাম নিজের গন্তব্যে এরও পর প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে তবেই আমার নতুন অফিস আগের অফিস বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ ছিল মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে অফিস যাওয়া আর বাড়ী ফেরা, এই ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিনের অংশ সেটা এখনও বজায় আছে বাস থেকে নেমেই মাকে ফোন করি বাবাকে সাধারণত বাসে ওঠার আগেই করি সেদিন বাবার সাথে কথা বলতে বলতেই ব্যাল্যান্স শেষ হয়ে গেল বাস থেকে নেমে মাকে আর ফোন করা হল না একা হাঁটতে ভীষণ খারাপ লাগে আমার ফোনে কথা বললে আর নিজেকে একা লাগে না  

বাস থেকে নেমে এই টুকু পথ হাঁটতেই আমার হাঁফ ধরে যায় অফিস পৌঁছে লিফটে চড়ে সোজা চলে যাই টপ ফ্লোরে এসেই ল্যাপটপের ব্যাগটা কাউচে ফেলে খোলা জানালার সামনে দাঁড়াই সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া ঘামে ভেজা মুখে এসে লাগে রোজ জানালার বাইরে দেখি এত ওপর থেকে দুর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা শহরটাকে দেখা যায় নানান রঙের ছোট বড় মাঝারি মাপের বাড়ি  ঘর কোথাও কোথাও সবুজের একটু ছোঁয়া এত বড় কংক্রিটের শহরে এইটুকু সবুজ যেন , কোন খরস্রোতা নদীর বুকে দু এক টুকরো কচুরি পানা এই নদীর স্রোতের সাথে লড়ায়ই করে ভেসে থাকাটাই বড় ব্যাপার । রোজ হাজার হাজার মানুষ এই লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে । কেউ খড় কুটো ধরে ভেসে চলেছে , কেও না তলিয়ে যাচ্ছে ।  এই সব ভাবতে ভাবতে  হঠাৎ চোখ গেল কিছু দুরের একটা বাড়িতে   বাড়িটা আর আমার অফিস এর মাঝে আছে অন্য একটা বাড়ি আর একটা রাস্তার ব্যবধান  

বাড়িটা চারতলার খোলা বারান্দায় এক স্ত্রী তার স্বামীর সাথে কথা বলছে স্ত্রীর গায়ে ঘরোয়া পোশাক আর স্বামী ধোপদুরস্ত প্যান্ট শার্ট পরে আছে দুজনে যেখানে দাঁড়িয়ে , তাদের ঠিক পেছনে একটা জানালা ,সেই জানালার ওপারে আরও কেউ কেউ আছে মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট বাচ্চা , আর এক বয়স্কা মহিলা এবার ভদ্রলোক  তার স্ত্রীর থেকে নিজের কালো ল্যাপটপ ব্যাগটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন  প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট মেয়ে বয়স দুই এর বেশি হবে না এসেই প্রথমে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর সে সিঁড়ির দিকে যেতে চাইল ওমনি তার মা তাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল বারান্দাটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা সেখানে লাইন দিয়ে ছোট ছোট টবে চারা গাছ লাগানো তারই একটা সরিয়ে দিয়ে মেয়েকে রেলিং ধরিয়ে দিল মা সাথে নিজেও দাঁড়াল, মেয়ের দুটো হাতে হাত রেখে দুজনের দৃষ্টি নিচের রাস্তার দিকে আমি গাছপালার জন্য নিচের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম  না বে মা মেয়ের মুখে হাসি দেখে  বুঝলাম, মেয়েটার বাবা নিচ থেকে তাদের কিছু বলছে সারাদিনের মত বিদায় জানাচ্ছে, আবার দেখা হবে সেই সন্ধ্যে বেলা বা হয়তো রাতেমেয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে তখন ছোট্ট হাত নেড়ে টাটা করল সে , তার পর ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার চলে যাওয়া দেখল ততক্ষণ ওরা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো যতক্ষণ তার বাবাকে দেখা যাচ্ছিল এর পর মা টবটা যথাস্থানে রেখে মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল    

এই দৃশ্য আমাকে মনে করিয়ে দেয় এক কাল্পনিক স্মৃতি কাল্পনিক বলছি কারন, দৃশ্য আমি নিজের স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাইনা বার বার একই গল্প শুনে শুনে নিজের মত করে এই স্মৃতি তৈরি করেছে আমার মন মস্তিষ্ক এই স্মৃতি এত উজ্জ্বল যে,  ভাবলেই মনে হয় আমি সব দেখতে পাচ্ছি কংসাবতী নদীর তীরে এক মা তার ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে, বাবা যাচ্ছে কাজে বাবার সাথে যাওয়ার জন্য মেয়ের চোখ ভরা জল  বাবার সাথে যাবে বলে সে মাকে সাজিয়ে দিতে বলেছিল  মা ভাল জামা জুতো পরিয়ে , চোখে কাজল লাগিয়ে দিয়েছিল , তাও যাওয়া হল না চোখের জলে তার কাজল মুছে গেল  অভিমানে চোখ ভরা জল নিয়ে সে মাকে জিজ্ঞেস করলযদি যাবইনা, তো আমি এত করে সাজলাম কেন’ ?  

আজ এই বহুতল বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দুটো ছবি একসাথে দেখি, পার্থক্য করতে পারিনা সেই অতীতের আর আজ এই বর্তমানের দুই শিশুর নুভুতির মধ্যে দুজনেই তাদের বাবার চলে যাওয়া দ্যাখে দুজনেই বাবার সাথে যেতে চায় দুজনের মা তাদের সামলে রাখে কেউ বাহুতলের পর থেকে পাকা রাস্তার মোড়ে তার বাবাকে মিলিয়ে যেতে দ্যাখে , কেউ বা নদীর বাঁকে কেউ হয়তো গাড়িতে ভয় পায় , কেউ ভুটভুটিতে (মেশিন চালিত ছোট নৌকা) 

অগ্রগতির চাকার তলায় চাপা পড়ে ছোট  ছোট কতো  গ্রাম, আর  অত্যাধুনিক  প্রযুক্তির  মধ্যে দিয়ে সেই গ্রাম থেকে  জন্ম নেয়  শহর  নদী শুকিয়ে মাঠ হয়, কালো চুল সাদা হয় , কালের নিষ্ঠুরতায় সেই শিশু একদিন বড় হয়ে যায় সময়ের প্রবল  স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সব শুধু নিয়ে যেতে পারেনা আমাদের নুভুতি , আবেগ , ভালবাসাকে সেই আদিম থেকে আধুনিক, সব মানুষের মধ্যে সেগুলো অপরিবর্তিতই থেকে গেছে মানুষের বয়স বাড়া সাথে সাথে যা হয় কিছু মার্জিত , কিছু সংযত, কিছুবা সযত্নে লুকিয়ে রাখা কোথাও অভিযোগের আড়ালে ভালবাসা প্রকাশ পায়, কোথাওবা ভালবাসা আড়ালে অভিমান   যদিও এসব আজও আমাদের মধ্যে সমান ভাবে বর্তমান, তবু আজ মানুষের সৃষ্টির কোটি কোটি বছরের পরেও শিশু মন একই রয়েগেছে, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, অবুঝ ও উদার সে তার মনের ভাব এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগেও গোপন করতে পারে না সৃষ্টির আদিকালের মতোই , ভাষা ছাড়াই অবলীলায় সে চিনে নিতে পারে আপনজনের স্নেহ ভালোবাসা, প্রকাশও করতে পারে সমান ভাবে ।

মৌমিতা সাহু
ব্যাঙ্গালোর,  ০৮/০৫/২০১৬




1 comment:

  1. Satyii khub sundar hoyachhe... Bhalo legechhe porte...

    ReplyDelete