এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের
মুখ দেখে কখনই মনে হয় না, পৃথিবীতে
এমন কি কিছু থাকতে পারে যা এই সব মানুষদের দুঃখী করতে পারে । যদি এই মানুষ দুখিও হন
, তবে সে দুঃখ আর যাই হোক , তাঁদের মন কে অশান্ত করতে পারেনা । তাই
তাদের মুখে দুঃখের কোন ছায়া পড়ে না । এ ধরনের
মানুষ কোন কিছুতেই বিস্মিত হন না , আপ্লুতও হন না , আবার ভেঙ্গেও পড়েন না । এরা
নিজেদের জগতে বাস করেন । এঁরা অন্যের বাধা মানেন না , আবার অন্যকে বাধাও দেন না
। এঁরা
নিজের মতো করে বাঁচতে ভালবাসেন, আর অন্যদের বাঁচতে দেন ।
এমনই একজনকে আমি চিনতাম ,
ছোট খাটো চেহারার মানুষটা , মাঝে মাঝেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠেন । মাথা ভরা পাকা চুল , রোদে পোড়া , যত্ন না নেওয়া , বয়সের ভারে মলিন হয়ে যাওয়া ফর্সা গায়ের রং । হাঁটুর নিচ পর্যন্ত খাটো ধুতি আর গায়ে হাফ হাতা জামা । কোনটাই ধোপ দুরস্ত নয় , আবার নোংরাও বলা যায় না । মনে হয় , নিজে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেন , কিন্তু এর চেয়ে বেশি পেরে ওঠেন না ।
চোখের চশমাটায় এতো বেশি পাওয়ার, যে তার চোখ দুটো খুব ছোট মনে হয় । চশমার
একদিকের ডাঁটিতে সুতো জড়ানো । আর মুখে ভীষণ সরল মিষ্টি এক হাসি লেগেই থাকে । এমন
হাসি মাখা মুখ মনে পড়লে , যে কোন মানুষের মনে শান্তি নেমে আসে আর অজান্তেই ঠোঁটের
কোনে লাগে মিষ্টি হাসির ছোঁয়া ।
শীত গ্রীষ্ম বর্ষা , বছরের যে কোন সময়, সঠিক দিন সঠিক
সময় ধরে যদি লক্ষ্য কর, এই মানুষটাকে একই সময়ে ঠিক একই জায়গায় পেয়ে যাবে
তুমি । তবে, তুমি একটু দেরি করলে কিন্তু আর দেখতে পাবে না । সাদা প্লাস্টিকের বস্তা সেলাই করে করে মাঝারি
মাপের একটা আসন বানানো, যার রং এখন ধূসর । তার পেছনের দিকে বসেন তিনি , আর সামনে
রাখা কিছু চিপসের প্যাকেট , কিছু চিনির পাটালি, আর কিছু গুড়ের পাটালি । ব্যাস , আর
কিছু না । যতো দিন দেখেছি এই দেখেছি । মঙ্গল বার হাটে রাস্তার এক ধারে, বা দুর্গা
পূজার প্যান্ডেলের বাম দিকের এক কোনে, কিংবা গার্লস স্কুলের সাইকেল বারান্দায়,
বছরের পর বছর একই ছবি মনে পড়ে । কখন আসেন
দেখি না , কখন চলে জান তাও দেখি না ,শুধু বসে থাকতেই দেখি । আমরা ছোটবেলায় তাঁকে ডাকতাম ‘চিপস দাদু’।
স্কুলের সাইকেল বারান্দায় টিফিনের সময় অনেক দোকান বসত । কেউ
ঘুগনি , কেউ মসলা মুড়ি আবার কেউ ফুচকা,
আবার কেউ কুলফি বিক্রি করত । তাদের আমরা খাওয়ারের নাম দিয়ে ডাকতাম । ঘুগনি দাদু,
চিপস দাদু , মুড়ি মাসি এই সব । এই চিপস
দাদুর থেকে প্রায় আমি চিপস নিতাম । প্রতি
চিপসের প্যাকেটের দাম পঞ্চাশ পয়সা । দাদু পয়সা নিতে চাইতেন না । আমি রোজ পয়সা
দিতাম । কাছে গেলেই জিজ্ঞেস করতেন ‘ভালো আছো মা? মা বাবা ভালো আছেন?’ আমি মাথা
নাড়িয়ে তিনি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতাম । কখনও কখনও তাঁর আসনের এক কোনে কিছুক্ষণ
বসতাম, বেশি কথা হত না, তাও কেন জানি বসতে ভালো লাগতো । মনে পড়ে দুর্গা পূজার
প্যান্ডেলের পাশে দেখা করতাম প্রতি বার ।
খানিক আলো আন্ধারিতে বসতেন । পুজোর প্রণাম করলেই কিছু চিপস আর পাটালি দিতে
চাইতেন । কোন বার নিতাম, কোন বার তাঁর বিক্রি হবে ভেবে নিতাম না । নিলেও খুশি হতেন
, না নিলেও। তাঁর দুঃখী মুখ মনে পড়ে না কিছুতেই । একদিন স্কুলে দুষ্টুমি করে
বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলাম । বলেছিলাম চিপস দাদুর থেকে আমি বিনা পয়সায় চিপস নিতে
পারি । কেউ বিশ্বাস করল না । প্রমাণ করতে , গিয়ে বসলাম দাদুর পাশে । একথা সেকথা
বলার পর বললাম , দাদু চলিগো । দাদু বললেন , কিছু নাও । আমি বললাম ,নানা । বললেন
, নাও না । আমি একটা চিপসের প্যাকেট নিলাম
। বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল , কি করে আনলি । আমি দুষ্টু চোখে হেসেছিলাম
। সে কথা
মনে পরলে আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয় ।
বাড়িতে চীর রুগ্ন তিক্ত মেজাজের স্ত্রীর সেভাবে যত্ন করতে
পারেন না
। মেয়েদের বেশি লেখা পড়া শেখাতে
পারেননি । তাই মনে মাঝে কিছু অসন্তোষ আসে ঠিকই, কিন্তু বেশি ক্ষণ থাকে না । এক মাত্র ছেলে , কি করে যে এত বুদ্ধিমান হল তাও
তিনি জানেন না । ছেলে কিভাবে যেন, নিজের
পড়ার খরচ নিজেই চালিয়ে নেয় । মাঝে মাঝে বাড়ি আসে , এলেই আগে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে
প্রণাম করে । গর্বে বুকটা ভরে যায় তাঁর। লেখাপড়া কি করে, কোথায় করে কিছুই ঠিক
জানেন না তিনি । জেনেই বা কি করবেন , শুধু এটুকুই জানেন তাঁর ছেলে খুব ভালো মানুষ
। আর তাঁর কিছুই চাই না। কিছুদিন পর ,
ছেলে কিছু টাকা পেতে শুরু করল । পড়ছে বলে নাকি টাকা পায় । বাড়ি এলেই হাতে টাকা দিয়ে যায় আর আদুরে গলায়
রাগি রাগি ভাব এনে তাঁকে কাজ করতে বারন করে ।
তবে বেশি জোরও করে না । কারন ছেলে বাবাকে ঠিক বোঝে। কিছু মানুষ কাজ করে, বাঁচার জন্য, টাকার
জন্য নয় । এই ছোট্ট ব্যাবসার জন্য রাস্তার ধারে বসে কতো মানুষের মুখ দেখেন তিনি,
যাদের কেউ তাঁকে লক্ষ্য করে কেও করে না । বছর বছর ধরে জীবনের স্রোত বয়ে যেতে
দেখেছেন চোখের সামনে । এতো বছরে এসবের
মধ্যেই তিনি যে সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন , সেই
অভ্যেস কি সহজে ছাড়া যায় ।
আজ প্রায় দশ বছরের
বেশি হয়ে গেল সেই মানুষটা আর নেই । সকালে গরুকে
জল দেওয়া , দুপুরে ভাতে ভাত রান্না , তার
পর বাজারে যাওয়া সবই ঠিক ছিল অন্য দিন গুলোর মতোই । রাতে খাওয়ার পর বুকে কেমন এক
চাপা বাথ্যা শুরু হল, কিছু ক্ষণের কষ্ট , তাঁর পর সব ঠিক হয়ে গেল । কাউকে কষ্ট
দিতেতো তিনি আসেননি , তাই কষ্ট দেনওনি ।
নিঃশব্দে হাসি মুখে চলে গেলন । মুখাগ্নির পর ছেলে দুরে বসে , বাবার চিতার ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টে । সে
দেখেছিল চিতার সাদা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে । তার পর কোত্থেকে
যেন এক দমকা হাওয়া এসে সেই ধোঁয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল উত্তর আকাশে । শ্মশান যাত্রীদের কেউ কেউ বলল , চিতার ধোঁয়া উত্তর আকাশে যাচ্ছে
, তবে তিনি স্বর্গেই যাচ্ছেন । স্কুলের সাইকেল বারান্দায় এখন আর কাউকে বসতে দেওয়া হয় না । হাটের সেই জায়গা দখল
করেছে অন্য এক ব্যাবসাই। আর পূজার প্যান্ডেলের
বাম দিকে কোনের জায়গাটা খালি আন্ধকার । আর তিনি আছেন ঐ হাওয়ায় অভিমুখে ।
মৌমিতা সাহু
ব্যাঙ্গালোর , 26/06/2016
Thank you very much for your feelings about my father. I want to share more information about this writing. Now I am in the way to college. I'll call you today evening. ...
ReplyDeleteSure , my pleasure :)
ReplyDelete