কোলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই (বোম্বাই) বা চেন্নাই (মাদ্রাজ)
শহরের মতো ব্যাঙ্গালুরু এত পুরনো শহর নয় । এই শহর সাহেবদের সময় তৈরি হলেও, তখনই
সেভাবে উন্নতি করেনি । সারা বছর প্রায় একই
রকম আবহাওয়া থাকার জন্য অনেক সাহেব সে সময়
ব্যাঙ্গালুরু ও তার আসে পাশের জায়গায়
নিজেদের থাকার জন্য কিছু কটেজ বাড়ি
বানিয়েছিলেন । ক্রমে আরও সাহেব আসেন এই শহরে , ফলে এখানে বেশ কিছু সাহেব কলনি গড়ে ওঠে । সাহেবরা এই সময় কিছু চার্চও তৈরি
করেছিলেন , তার সব গুলোই এখনো মাথা উঁচু
করে এই শহরের এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । মাঝে মাঝে সময় পেলে কোন কোন রবিবার সেই
সব চার্চে যাই । কোন কোনটায় এখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো খোদাই রয়েছে ।
এখানকার অনেক স্কুল কলেজ সেই সময়ের তৈরি । সাহেবরা তাদের বসবাসের উপযুক্ত
করার জন্য সব ব্যবস্থাই করেছিলেন । স্কুল, কলেজ, রাস্তা, কলনি, হাসপাতাল সবই । তবু
এখানে জনবসতি সেভাবে বেড়ে ওঠেনি । তার কারন , এই শহরে জলের সমস্যা , যোগাযোগের
সমস্যা , কোলকাতা, মুম্বাই বা চেন্নাই এর
মত সমুদ্র বা বড় নদী নেই । তাই বড় লোকদের আরামের জায়গা হিসেবে ভালো হলেও , সাধারণ
মানুষের জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট কর্ম সংস্থানের
অভাব পঁচিশ বছর আগে পর্যন্তও ছিল । এই শহরের যে সব জায়গায় সন্ধ্যার পর
মানুষ যেতে ভয় পেত, জঙ্গলে ভরা ছিল সেসব জায়গায় এখন রাত পর্যন্ত ট্রাফিকের ভিড়ে
মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত । ছোটও পুল এখন হয়েছে বিশাল উড়াল পুল যুক্ত চৌমাথা । মেইন রোড , সার্ভিস রোড, ফুটপাথে লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ঠাসা । এখন এই শহরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন
ভাষার হাজার হাজার মানুষ আসছে , কাজের খোঁজে । ভারতবর্ষে সফটওয়্যার ওয়ার্ল্ডের
ব্যাঙ্গালোর হল হাব । পাঁচ হাজারেরও বেশি
সফটওয়্যার কম্পানি আছে এখানে । বড় বড় শপিং
মল, গাড়ি, বাড়ি, পার্ক , হাসপাতাল , পাঁচতারা, সাততারা হোটেল , মেট্রো , প্লে
স্কুল থেকে বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেল
কলেজ কি নেই এই শহরে । নেই শুধু নিজস্বতা ।
আগে প্রচুর গাছপালা থাকার জন্য এই শহরকে ‘গার্ডেন সিটি’ বলা হত । এখন বিশাল
বিশাল বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হওয়ার কারনে সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে । গাছপালা কমে
গিয়ে সফটওয়্যার কোম্পানি ক্রমেই বেড়ে উঠেছে , তাই গার্ডেন সিটি থেকে এখন এই শহর পরিবর্তিত হয়েছে ‘সিলিকন সিটি’ তে । এখানকার স্থানীয় ভাষা কন্নড়
হলেও, এখানকার মানুষজন হিন্দি আর ইংরেজি ভালোই বলে। তাই মোটামুটি এখানে কথা বলতে
বিশেষ অসুবিধে নেই। কথা বলে বোঝা যায় না , মানুষটা তামিল, তেলেগু, বাঙালি, বিহারি,
গুজরাতি , মালায়ালি নাকি কানাড়া । হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর পর , এই শহরের মানুষ কোন এক
নতুন ভাষায় কথা বলবে । হয়তোবা ব্যাঙ্গালোরিয়ান
ভাষা , কোন টেকনিকেল ভাষা হওয়াই স্বাভাবিক । যে ভাষায় মানুষ বলতে লিখতে পারবে আর
টেকনোলজিতেও ব্যাবহার করবে ।
এখানে তিন বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন , আমার প্রথম দুমাসে
আমার ওজন কমে গিয়েছিল পাঁচ কেজি । পিজি ( পেয়িং গেস্ট ) তে থাকতাম , খাওয়ার
স্টাইল ছিল অন্ধ্রা । কিছুই খেতে পারতাম না , তখন আর্থিক সামর্থ্য এমন ছিল না যে ,
রোজ বাইরে খেতে যাবো । আর এখন নিজে যা
খুশি বানিয়ে খেয়ে খেয়ে ওজন দশ কেজি বাড়িয়েছি ।
তাই স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে মাঝে মাঝে সকালে হাঁটতে বেরই । আমার বাসার উত্তর দিকে
একটা ছোট্ট পার্ক আছে । সেখানে সকাল বিকাল কিছু মানুষ হাঁটা চলা করেন , কেউ কেউ
বসে গল্প করেন , কিছু ছোট ছোট বাচ্চা দোলনায় ঝোলে ,খেলে বেড়ায় । আমি পার্কের
চারপাশে চক্কর লাগাতে লাগাতে নানা রকম মানুষদের লক্ষ্য করি । কেউ বাঙালি , কেউ
ওড়িয়া কেউ কানাড়া । বিদেশে মাতৃ ভাষায় কথা
বলার সুযোগ পেলে মানুষ ভীষণ সুখী হয় । মনে করেন নিজের কাউকে পেয়েছেন । সেই অজানা
আচেনা মানুষের কাছে কতো কিছু বলে ফেলেন । হাঁটতে হাঁটতে বা, মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার
জন্য বসলে , আসে পাশের কথা শুনি । কেউ রোগ
অসুখ নিয়ে কথা বলে , কেউ বা ছেলে মেয়ের কথা , কেউ আবার টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলে ।
সেদিনটা ছিল এক শনিবার , আমার ছুটির দিন । আমি অন্যান্য দিনের
মতোই পার্কের গেটে ঢুকে বাম দিকের রাস্তা
ধরে হাঁটতে শুরু করলাম । আমার সামনে এক বয়স্ক ভদ্র লোক জগিং করছেন । সাধারণ
প্যান্ট , টি -শার্ট ইন করা আর পায়ে স্নিকারস । বেশ জোরে জোরেই জগিং করছেন
। বয়স ষাঠের আসে পাশেই হবে মনে হয় । শরীর যথেষ্ট ফিট হলেও, মুখে বয়সের ছাপ
স্পষ্ট ।
আমার একবার ঘোরা হলে ওনার দেড় বার ঘোরা হয় । পার্কের চারপাশে আর মাঝে বসার
জন্য ব্রেঞ্চ রাখা আছে । হাঁটার পর সেখানে
সবাই বিশ্রামের জন্য বসে । আমি হাঁপিয়ে পরলে মিনিট তিনেক বসি আবার হাঁটি তারপর সোজা বাড়ি চলে আসি । সেদিন চার
পাক ঘোরার পর দেখি, আর এক ভদ্রলোক একটা
বেঞ্চে পায়ের ওপর পা দিয়ে গালে হাত দিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছেন । তাঁকে আগে কখনো দেখিনি । তার গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় ছোট টুপি, পায়ে স্যান্ডেল । পাজামা
স্বভাবতই গোড়ালির বেস ওপরে শেষ হয়েছে ।
মাথায় কাঁচা পাকা চুল , মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি ।
তাঁর জামা বেশি সাদা নাকি গায়ের রং
সেটা বলা বেস শক্ত । বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল । চল্লিশ বললে কম হবে, পঞ্চাশ বললেও
হয়ত কম হবে । ষাঠ বললে বেশি হবে কিনা জানি না । তাঁর ঋজু দেহ মুখের চামড়া দেখে
বোঝার উপায় নেই, তিনি শেষ কতদিন ধরে এই পৃথিবীর বাসিন্দা । তবে তাঁর চোখে এক
আদ্ভুত চাহুনি, যেন কাতো কাল ধরে কতো কি দেখেছেন । তাঁর আশেপাশে যেন কিসের একটা
মায়াজাল আছে । আমি সাধারণত খালি বেঞ্চ দেখেই বসি । কিন্তু সেদিন তাঁকে দেখার পর মন
খুব চাইলো ওনার সাথে কিছু কথা বলি । এত সকালে সাধারণত কেউ একা এই পার্কে গালে হাত দিয়ে বসে না । তাছাড়া শনিবার ,অফিস
যেতে হবে না যখন একটু বসেই পড়ি ।
পাঁচ পাক ঘোরার পর সেই বেঞ্চের সামনে এসে বললাম ,
আমি- আঙ্কেল , গুড
মর্নিং ।
( আমি তাঁর নাম জানি না । তবে কথা বলে তিনি সুজন বলেই মনে
হয়েছিল । তাই তাঁকে সুজন বলেই নামকরন করলাম ।)
সুজন - আও বেটি
বেয়ঠো ।
তাঁর সেই গলার স্বরে কি যেন ছিল । এত মার্জিত সুরেলা গম্ভীর স্বর আমি আগে কখনো
শুনিনি । সে স্বরকে উপেক্ষা করা যায় না , অবহেলা করা যায় না । সে স্বরে যেন কোথায়
একটু কষ্টের ছোঁয়া আছে । আমার মনে এত সব কথা মুহূর্তের মধ্যে এলেও, সব এক দিকে
সরিয়ে রেখে তাঁর বাম দিকে বসে তাঁকে ইংরেজিতে বললাম ,
আমি - সকাল সকাল
গালে হাত দিয়ে বসেছেন কেন?
সুজন - তিনি উদাস চোখে আমার দিকে তাকালেন, বুঝলাম তিনি ঠিক
বুঝতে পারলেন না ।
আমি - হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম , আপনি হিন্দি বুঝতে পারেন ?
সুজন - হ্যাঁ , আমি হিন্দি জানি ।
এর পর আমার সাথে তাঁর হিন্দিতেই কথা হয় ।
আমি - সকাল সকাল
গালে হাত দিয়ে বসেছেন কেন?
সুজন - এমনি এমনি বেটি ।
আমি - এই সকাল
বেলায় গালে হাত দিয়ে বসে এতো কি চিন্তা করছেন ।
সুজন - সমস্যা কার জীবনে নেই বেটি?
আমি - হ্যাঁ , সবার জীবনেই আছে, তবে এভাবে বসে বসে চিন্তা
করলে কি কিছু হবে? এতো ভাববেন না । যা হবে তা হবেই ।
সুজন - তুমি কি এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা?
আমি - না , আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছি । চাকরি করতে ।
সুজন - আচ্ছা, আমি কাশ্মীর থেকে এসেছি। আমার নাতির অসুখ ,
তাকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি । এখানে আমার মেয়ে জামাই থাকে ।
আমি- (অবাক হয়ে)
কাশ্মীর ! আপনার নাতি কেমন আছে এখন ?
সুজন - হ্যাঁ , কাশ্মীর । ওপরওয়ালার কৃপায়, নাতি ভালো আছে ।
এই আট তারিখ বাড়ি ফিরবো।
আমি - আমি কখনো কাশ্মীর যাইনি , সিনেমাতে দেখেছি । কি
সুন্দর জায়গা তাই না ! আপনারতো এখানে খুব কস্ট
হচ্ছে নিশ্চয়ই ।
সুজন - কি বলব বেটি, চল্লিশ দিন এখানে এসেছি, মনে হচ্ছে
চল্লিশ বছর হয়ে গেছে বাড়ি থেকে এসেছি ।
আমি - ওখানকার আবস্থা এখন কেমন?
সুজন - আগের থেকে অনেক ভালো ।
আমি - সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেরতে পারেন ?
সুজন - হ্যাঁ পারি । তবে চারই দিকে অনেক ফোরস থাকে ।
আমি - খুব চেকিং হয় কি?
সুজন - হ্যাঁ বেটি । রাতে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার খুব অসুবিধা । রাস্তায় তিন চার জায়গায় চেকিং হয় ।
আমি- বুঝতে পারছি, কিন্তু কি করা যাবে , ওরা তো ওদের ডিউটি
করছে । আপনি বললেন এখন অবস্থা ভালো। এই
শেষ দুবছরে কিছু পরিবর্তন দেখলেন?
সুজন - হ্যাঁ , অনেক পরিবর্তন হয়েছে ।
আমি - আপনার কি মনে হয় , এই সরকার থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভালো
হবে ?
সুজন - নিশ্চই ভালো
হবে ।
আমি - (শুনে ভালো লাগলো )
আপনি তো অনেক কিছু দেখেছেন । কিছু
বলুন ।
সুজন - কাশ্মীর খুব
শান্তি প্রিয় জায়গা ছিল । দিন রাত্রি যে কোন সময় যেখানে খুশি যেতে পারতো মানুষ ।
এখানের মতই সবাই খুশি খুশি থাকত । অমন ছিল ওখানে । মাঝে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল ,তবে এখন কিছু
ভালো ।
আমি - আচ্ছা আপনার কি মনে হয় , এই ধর্মের নামে দাঙ্গায়
মানুষ নিজের ধর্মের মানুষেরই বেশি প্রাণ নিয়েছে?
সুজন - বেটি , যারা
ওপরওয়ালার কাছে মাথা নোয়ায় না , তাদের আবার ধর্ম কি?
আমি - এখানে ছোট ছোট ফ্ল্যাট বাড়িতে আপনার থাকতে কষ্ট হচ্ছে
নিশ্চয়ই ।
সুজন - এখানের একটা ফ্ল্যাট যতো বড় , আমাদের রসোই (রান্না ঘর) ততো বড় । আর এই পার্কটা যতো বড়,
আমাদের বাড়ির ভেতরে এতো বড় বসার ঘর । আঠেরটা ঘর আছে । আপেল বাগান আছে ।
আমি - আপনার তো তাহলে খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে ।
সুজন - তবে এখানে চাকরি করে থাকার জন্য ভালো । এখানের মানুষ
জন ভালো । আমার নাতিকে নিয়ে প্রথমে দিল্লী গেলাম , সেখানে খুব অসুবিধা হল। গরমও
খুব । তাই এখানে চলে এলাম ।
আমি - হ্যাঁ এখানে মানুষজন ভালো করে কথা বলে । দরকারে
সাহায্যও করে । আচ্ছা আপনি বলছিলেন , আপনাদের আপেল বাগান আছে । নিজেদের বাগান?
সুজন - নিজেদেরও আছে , আবার কেনা বাগান ও আছে । ১ বছর বা ২ বছরের জন্য বাগান কিনতে পাওয়া যায়
। আপেল এক বছর ফলে , পরের বছর ফলে না ।
আমি - আপেল গাছ থেকে আপেল কি হাতে করে পাড়েন?
সুজন - হ্যাঁ, ছোট গাছ হয় । হাতেই পাড়া হয় ।
আমি - এক বছর আপেল হয় অন্য বছর হয় না , তবু আমরা প্রতি বছরই
আপেল পাই । কি করে?
সুজন - আমরা স্টোর করে রাখি ।
আমি - আপনার কোল্ড স্টোরেজ আছে?
সুজন - না না , আমাদের ওখানে তো খুব ঠাণ্ডা , শীতে বরফ পড়ে
, তাই স্টোরেজ লাগে না । কাঠের ঘরের ছাউনি বানিয়ে রাখি , যাতে বরফ না পড়ে ।
আমি - ঐ আপেল কি কোন জুস কোম্পানি নিয়ে যায়?
সুজন - হ্যাঁ নিয়ে যায় , যে সব পাকা আপেল গাছ থেকে পড়ে ফেটে যায় , সেগুলোকে আলাদা
বস্তায় ভরে , জুস কোম্পানি নিয়ে যায় ।
আমি - ওখানে আর কি চাষ হয়?
সুজন - সবই কম বেশি হয় , ধান গম ও হয় । আখরোট, পিস্তা,
বাদাম (আল্মনড ) , পেয়ারা সব হয় । আমি দুই
বছর কোলকাতায় গেছি আপেলের ব্যাবসা করতে
।
আমি - আচ্ছা । আর
কদিন পরেই চলে যাবেন । আপনার মতো বাড়ির সবাইও আপনার জন্য আপেক্ষা করছে নিশ্চই ।
সুজন - হ্যাঁ , এখানে কে আছে বেটি, আপনজন বন্ধু সবই তো
ওখানে। নিজের জায়গা ছেড়ে থাকতে কি ভাল লাগে?
আমি - জানি , আমার বাবা মা , বছরে একবার আমাদের কাছে আসেন ,
তাদের চোখে মুখেও আমি এই কষ্ট দেখি ।
বুঝছিলাম, সুজনের
মনের মেঘ একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে , এমন সময় আমার বাম দিকের বেঞ্চ থেকে
ইংরিজিতে একটা প্রশ্ন এল ...
-তোমার নাম কি?
মুখ ফিরিয়ে দেখি, সেই ভদ্র লোক , যিনি আমার সামনে সামনে
জগিং করছিলেন । কখন যেন এসে আমাদের পাশের বেঞ্চে বসেছেন । তিনি তাঁর নাম বলে সেদিন
নিজের পরিচয় দিলেও, আজ কিছুতেই তাঁর নাম মনে করতে পারলাম না , তাই তাঁর নাম দিলাম
সৃজন , কারন তাঁর সাথে কথা বলে তিনি যে জীবনে খুব সফল তা বুঝেছিলাম ।
আমি - আমি মৌমিতা ।
সৃজন- আমি মিস্টার
আর এস স্বামিনাথন । (নামটা আমার বানানো , কারন আমি ভুলে গেছি আসল নাম । )
আমি - আচ্ছা । আপনি হিন্দি বোঝেন ?
সৃজন - না , ইংরেজি আর তামিল ।
আমি - আচ্ছা । (বুঝলাম উনি তামিলনাডু থেকে এসেছেন )। এর পর
ওনার সাথে ইংরাজিতেই কথা হল ।
সৃজন - কোন কোম্পানিতে কাজ করো তুমি ?
আমি - আমি আমার নতুন এবং পুরনো কোম্পানি সম্বন্ধে যথেষ্ট খবর
দিলাম । কোথায় কোম্পানি , কতো দিনের পুরনো
কোম্পানি। কোম্পানি কি কাজ করে । এই সব ।
সৃজন - আমি চাকরি করতাম , রিটায়ার করেছি । আমার স্ত্রী
রিটায়ার প্রফেসর । আমার ছেলে মেয়ে ,জামাই বউমা সবাই ইউ এস এ তে সেটেলড ।
ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে মেয়ে ।
ছেলে মেয়ে কোন কোন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে তাও
বললেন ।
আমি- হাসি মুখে বললাম ,
আচ্ছা।
সৃজন কিন্তু চুপ করে
থাকলেন না । তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেন। আমি কতো দিন এখানে আছি । আমার
কাজের ডোমেইন কি । কার সাথে থাকি । নতুন অফিস কিভাবে যাই ।
আমি তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম সাথে এও বোঝালাম তাঁকে,
যে আমি কেন মালটিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া সত্যেও , একটা কয়েক মাসের নতুন
কোম্পানিতে ঢুকলাম । আমি আমার কেরিয়ার
নিয়ে বেশ সিরিয়াস দেখে , তিনি বেশ খুশি
হলেন । তাঁর পর জিজ্ঞেস করলেন ,
সৃজন - তুমি কি খুব শরীর সচেতন ?
আমি - না , খুব বেশি না , তবে কিছুটা। আমার পায়ে বাথ্যা আছে তাই জোরে হাঁটতে পারি না
।
সৃজন - আমার বয়স ৬৫ , এই পার্কের আমি ১৫ বার চক্কর লাগাই ।
আমি- (বুঝলাম তিনি কি
শুনতে চান ) ওহঃ , আপনাকে দেখে মনেই হয়না আপনার বয়স ৬৫ ।
সৃজন - তুমি ধীরে হাঁটো, জগিং করার দরকার নেই ।
আমি - আচ্ছা ।
সৃজন বেশ খুশি হলেন । এমনি সময় আমায় চমকে দিয়ে , সুজন পেছন থেকে মিষ্টি হেসে, ‘আমি চলি বেটি’ বলেই উঠে দাঁড়ালেন
। আমার ‘আচ্ছা’ বলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না । অন্য দিক থেকে সৃজন ও বললেন ‘ওকে
মৌমিতা , নাইস টু মিট ইউ’ । আমি বললাম ‘সেম টু ইউ স্যার’ ।
সুজন সৃজন দুজনেই চলে গেলেন । আমি একা বসে থাকলাম পার্কের
বেঞ্চে ।
সৃজন এই পৃথিবী অনেক দেখেছে । কিন্তু সুজন , তার দেখা কি
আজকাল পাওয়া যায় সহসা ? এমন এক মানুষ যার মনের পবিত্রতা তাঁর মুখে চোখে শরীরে ছাপ
রেখে গেছে । সিদ্দিক কাকুর পর ,এমন মানুষ আমার আর চোখে পড়েনি । আজ মন বলছিল এমনই কেও ছিলেন তিনি । কতো কথা বলার ছিল , কতো কথা শোনার ছিল , জানার
ছিল , বাকি থেকে গেল সবই । মনটা উদাস হয়ে
গেল । মুহূর্তের বর্তমান মুহূর্তেই অতীত হয়ে
যায় । এক সুজনের সাথে দেখা হল, সে কথা আমি
কখনও বলতে পারব না । বলতে হবে দেখা হয়েছিল , কথা হয়েছিল । এভাবেই ছোট ছোট স্মৃতি
নিয়ে এই শহরও পুরনো হতে থাকবে । আর আমি চলব বর্তমানে , আবিষ্কার করব নতুন নতুন
সুজনের ।
আজই
তোমার দিন, বেঁচে নাও ক্ষণ ।
কাল
ছিল , কাল হবে , বদলাবে সন ।।
মৌমিতা সাহু , ব্যাঙ্গালোর
২০/০৬/২০১৬
Lekha pore mone hochhe tui likhte Paris...amar toh khub bhalo legechhe. . . bishes kore picturization ta clear. Parbi kichhu korte.very good writing... Continue it
ReplyDeleteTumi porecho , etei ami khusi :)
ReplyDelete