Sunday, 19 June 2016

অতীত

কোলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই (বোম্বাই) বা চেন্নাই (মাদ্রাজ) শহরের মতো ব্যাঙ্গালুরু এত পুরনো শহর নয় । এই শহর সাহেবদের সময় তৈরি হলেও, তখনই সেভাবে  উন্নতি করেনি । সারা বছর প্রায় একই রকম আবহাওয়া থাকার জন্য অনেক সাহেব সে  সময় ব্যাঙ্গালুরু ও তার আসে পাশের  জায়গায় নিজেদের থাকার জন্য কিছু  কটেজ বাড়ি বানিয়েছিলেন । ক্রমে আরও সাহেব আসেন এই শহরে , ফলে এখানে বেশ  কিছু সাহেব কলনি  গড়ে ওঠে । সাহেবরা এই সময় কিছু চার্চও তৈরি করেছিলেন , তার সব গুলোই এখনো মাথা  উঁচু করে এই শহরের এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । মাঝে মাঝে সময় পেলে কোন কোন রবিবার সেই সব চার্চে যাই । কোন কোনটায় এখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো  খোদাই রয়েছে ।  এখানকার অনেক স্কুল কলেজ সেই সময়ের তৈরি । সাহেবরা তাদের বসবাসের উপযুক্ত করার জন্য সব ব্যবস্থাই করেছিলেন । স্কুল, কলেজ, রাস্তা, কলনি, হাসপাতাল সবই । তবু এখানে জনবসতি সেভাবে বেড়ে ওঠেনি । তার কারন , এই শহরে জলের সমস্যা , যোগাযোগের সমস্যা ,  কোলকাতা, মুম্বাই বা চেন্নাই এর মত সমুদ্র বা বড় নদী নেই । তাই বড় লোকদের আরামের জায়গা হিসেবে ভালো হলেও , সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট কর্ম সংস্থানের  অভাব পঁচিশ বছর আগে পর্যন্তও ছিল । এই শহরের যে সব জায়গায় সন্ধ্যার পর মানুষ যেতে ভয় পেত, জঙ্গলে ভরা ছিল সেসব জায়গায় এখন রাত পর্যন্ত ট্রাফিকের ভিড়ে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত । ছোটও পুল এখন হয়েছে বিশাল উড়াল পুল যুক্ত চৌমাথা ।  মেইন রোড , সার্ভিস রোড,  ফুটপাথে লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ঠাসা ।  এখন এই শহরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভাষার হাজার হাজার মানুষ আসছে , কাজের খোঁজে । ভারতবর্ষে সফটওয়্যার ওয়ার্ল্ডের ব্যাঙ্গালোর হল হাব ।  পাঁচ হাজারেরও বেশি সফটওয়্যার কম্পানি আছে এখানে ।  বড় বড় শপিং মল, গাড়ি, বাড়ি, পার্ক , হাসপাতাল , পাঁচতারা, সাততারা হোটেল , মেট্রো , প্লে স্কুল থেকে  বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেল কলেজ কি নেই এই শহরে । নেই শুধু নিজস্বতা । 

আগে প্রচুর গাছপালা থাকার জন্য  এই শহরকে ‘গার্ডেন সিটি’ বলা হত । এখন বিশাল বিশাল বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হওয়ার কারনে সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে । গাছপালা কমে গিয়ে সফটওয়্যার কোম্পানি ক্রমেই বেড়ে উঠেছে , তাই গার্ডেন সিটি থেকে এখন এই শহর  পরিবর্তিত হয়েছে  ‘সিলিকন সিটি’ তে । এখানকার স্থানীয় ভাষা কন্নড় হলেও, এখানকার মানুষজন হিন্দি আর ইংরেজি ভালোই বলে। তাই মোটামুটি এখানে কথা বলতে বিশেষ অসুবিধে নেই। কথা বলে বোঝা যায় না , মানুষটা তামিল, তেলেগু, বাঙালি, বিহারি, গুজরাতি , মালায়ালি নাকি কানাড়া । হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর পর , এই শহরের মানুষ কোন এক নতুন ভাষায় কথা বলবে । হয়তোবা  ব্যাঙ্গালোরিয়ান ভাষা , কোন টেকনিকেল ভাষা হওয়াই স্বাভাবিক । যে ভাষায় মানুষ বলতে লিখতে পারবে আর টেকনোলজিতেও ব্যাবহার করবে ।

এখানে তিন বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন , আমার  প্রথম দুমাসে  আমার ওজন কমে গিয়েছিল পাঁচ কেজি । পিজি ( পেয়িং গেস্ট ) তে থাকতাম , খাওয়ার স্টাইল ছিল অন্ধ্রা । কিছুই খেতে পারতাম না , তখন আর্থিক সামর্থ্য এমন ছিল না যে , রোজ বাইরে খেতে যাবো ।  আর এখন নিজে যা খুশি বানিয়ে খেয়ে খেয়ে ওজন দশ কেজি বাড়িয়েছি ।  তাই স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে মাঝে মাঝে সকালে হাঁটতে বেরই । আমার বাসার উত্তর দিকে একটা ছোট্ট পার্ক আছে । সেখানে সকাল বিকাল কিছু মানুষ হাঁটা চলা করেন , কেউ কেউ বসে গল্প করেন , কিছু ছোট ছোট বাচ্চা দোলনায় ঝোলে ,খেলে বেড়ায় । আমি পার্কের চারপাশে চক্কর লাগাতে লাগাতে নানা রকম মানুষদের লক্ষ্য করি । কেউ বাঙালি , কেউ ওড়িয়া  কেউ কানাড়া । বিদেশে মাতৃ ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেলে মানুষ ভীষণ সুখী হয় । মনে করেন নিজের কাউকে পেয়েছেন । সেই অজানা আচেনা মানুষের কাছে কতো কিছু বলে ফেলেন । হাঁটতে হাঁটতে বা, মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসলে , আসে পাশের কথা শুনি ।  কেউ রোগ অসুখ নিয়ে কথা বলে , কেউ বা ছেলে মেয়ের কথা , কেউ আবার টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলে ।

সেদিনটা ছিল এক শনিবার , আমার ছুটির দিন । আমি অন্যান্য দিনের মতোই  পার্কের গেটে ঢুকে বাম দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম । আমার সামনে এক বয়স্ক ভদ্র লোক জগিং করছেন । সাধারণ প্যান্ট , টি -শার্ট  ইন করা  আর পায়ে স্নিকারস । বেশ জোরে জোরেই জগিং করছেন । বয়স ষাঠের আসে পাশেই হবে মনে হয় । শরীর যথেষ্ট ফিট হলেও, মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট    আমার একবার ঘোরা হলে ওনার দেড় বার ঘোরা হয় । পার্কের চারপাশে আর মাঝে বসার জন্য ব্রেঞ্চ রাখা আছে । হাঁটার পর  সেখানে সবাই বিশ্রামের জন্য বসে । আমি হাঁপিয়ে পরলে মিনিট তিনেক বসি আবার হাঁটি  তারপর সোজা বাড়ি চলে আসি ।   সেদিন চার পাক ঘোরার পর দেখি, আর  এক ভদ্রলোক একটা বেঞ্চে পায়ের ওপর পা দিয়ে গালে হাত দিয়ে মুখ নিচু করে  বসে আছেন । তাঁকে আগে কখনো দেখিনি ।  তার গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি,  মাথায় ছোট টুপি, পায়ে স্যান্ডেল । পাজামা স্বভাবতই  গোড়ালির বেস ওপরে শেষ হয়েছে । মাথায় কাঁচা পাকা চুল , মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি ।  তাঁর জামা বেশি সাদা নাকি  গায়ের রং সেটা বলা বেস শক্ত । বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল । চল্লিশ বললে কম হবে, পঞ্চাশ বললেও হয়ত কম হবে । ষাঠ বললে বেশি হবে কিনা জানি না । তাঁর ঋজু দেহ মুখের চামড়া দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি শেষ কতদিন ধরে এই পৃথিবীর বাসিন্দা । তবে তাঁর চোখে এক আদ্ভুত চাহুনি, যেন কাতো কাল ধরে কতো কি দেখেছেন । তাঁর আশেপাশে যেন কিসের একটা মায়াজাল আছে । আমি সাধারণত খালি বেঞ্চ দেখেই বসি । কিন্তু সেদিন তাঁকে দেখার পর মন খুব চাইলো ওনার সাথে কিছু কথা বলি । এত সকালে সাধারণত কেউ একা এই পার্কে  গালে হাত দিয়ে বসে না । তাছাড়া শনিবার ,অফিস যেতে হবে না যখন একটু বসেই পড়ি ।
পাঁচ পাক ঘোরার পর সেই বেঞ্চের সামনে এসে বললাম ,

আমি-  আঙ্কেল , গুড মর্নিং ।
( আমি তাঁর নাম জানি না । তবে কথা বলে তিনি সুজন বলেই মনে হয়েছিল । তাই তাঁকে সুজন বলেই নামকরন করলাম ।)
সুজন  - আও বেটি বেয়ঠো ।

তাঁর সেই গলার স্বরে কি যেন ছিল ।  এত মার্জিত সুরেলা গম্ভীর স্বর আমি আগে কখনো শুনিনি । সে স্বরকে উপেক্ষা করা যায় না , অবহেলা করা যায় না । সে স্বরে যেন কোথায় একটু কষ্টের ছোঁয়া আছে । আমার মনে এত সব কথা মুহূর্তের মধ্যে এলেও, সব এক দিকে সরিয়ে রেখে তাঁর বাম দিকে বসে তাঁকে ইংরেজিতে বললাম ,
আমি -  সকাল সকাল গালে হাত দিয়ে বসেছেন কেন?
সুজন - তিনি উদাস চোখে আমার দিকে তাকালেন, বুঝলাম তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না ।
আমি - হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম , আপনি হিন্দি বুঝতে পারেন ?
সুজন - হ্যাঁ , আমি হিন্দি জানি ।

এর পর আমার সাথে তাঁর হিন্দিতেই কথা হয় ।
আমি -  সকাল সকাল গালে হাত দিয়ে বসেছেন কেন?
সুজন - এমনি এমনি বেটি ।
আমি -  এই সকাল বেলায় গালে হাত দিয়ে বসে এতো কি চিন্তা করছেন ।
সুজন - সমস্যা কার জীবনে নেই বেটি?
আমি - হ্যাঁ , সবার জীবনেই আছে, তবে এভাবে বসে বসে চিন্তা করলে কি কিছু হবে? এতো ভাববেন না । যা হবে তা হবেই ।
সুজন - তুমি কি এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা?
আমি - না , আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছি । চাকরি করতে ।
সুজন - আচ্ছা, আমি কাশ্মীর থেকে এসেছি। আমার নাতির অসুখ , তাকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি । এখানে আমার মেয়ে জামাই থাকে ।
আমি- (অবাক হয়ে)  কাশ্মীর ! আপনার নাতি কেমন আছে এখন ?
সুজন - হ্যাঁ , কাশ্মীর । ওপরওয়ালার কৃপায়, নাতি ভালো আছে । এই আট তারিখ বাড়ি ফিরবো।
আমি - আমি কখনো কাশ্মীর যাইনি , সিনেমাতে দেখেছি । কি সুন্দর জায়গা তাই না ! আপনারতো এখানে খুব কস্ট  হচ্ছে নিশ্চয়ই ।
সুজন - কি বলব বেটি, চল্লিশ দিন এখানে এসেছি, মনে হচ্ছে চল্লিশ বছর হয়ে গেছে বাড়ি থেকে এসেছি ।
আমি - ওখানকার আবস্থা এখন কেমন?
সুজন - আগের থেকে অনেক ভালো ।
আমি - সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেরতে পারেন ?
সুজন - হ্যাঁ পারি । তবে চারই দিকে অনেক ফোরস থাকে ।
আমি - খুব চেকিং হয় কি?
সুজন - হ্যাঁ বেটি । রাতে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার খুব অসুবিধা । রাস্তায় তিন চার জায়গায় চেকিং হয় ।
আমি- বুঝতে পারছি, কিন্তু কি করা যাবে , ওরা তো ওদের ডিউটি করছে ।  আপনি বললেন এখন অবস্থা ভালো। এই শেষ দুবছরে কিছু পরিবর্তন দেখলেন?
সুজন - হ্যাঁ , অনেক পরিবর্তন হয়েছে ।
আমি - আপনার কি মনে হয় , এই সরকার থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে ?
সুজন - নিশ্চই  ভালো হবে ।
আমি - (শুনে ভালো লাগলো )  আপনি তো অনেক কিছু দেখেছেন ।  কিছু বলুন ।
সুজন -  কাশ্মীর খুব শান্তি প্রিয় জায়গা ছিল । দিন রাত্রি যে কোন সময় যেখানে খুশি যেতে পারতো মানুষ । এখানের মতই সবাই খুশি খুশি থাকত । অমন ছিল ওখানে ।  মাঝে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল ,তবে এখন কিছু ভালো ।
আমি - আচ্ছা আপনার কি মনে হয় , এই ধর্মের নামে দাঙ্গায় মানুষ নিজের ধর্মের মানুষেরই বেশি প্রাণ নিয়েছে?
সুজন - বেটি , যারা  ওপরওয়ালার কাছে মাথা নোয়ায় না , তাদের আবার ধর্ম কি?
আমি - এখানে ছোট ছোট ফ্ল্যাট বাড়িতে আপনার থাকতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই ।
সুজন - এখানের একটা ফ্ল্যাট যতো বড় , আমাদের রসোই  (রান্না ঘর) ততো বড় । আর এই পার্কটা যতো বড়, আমাদের বাড়ির ভেতরে এতো বড় বসার ঘর । আঠেরটা ঘর আছে ।  আপেল বাগান আছে ।
আমি - আপনার তো তাহলে খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে ।
সুজন - তবে এখানে চাকরি করে থাকার জন্য ভালো । এখানের মানুষ জন ভালো । আমার নাতিকে নিয়ে প্রথমে দিল্লী গেলাম , সেখানে খুব অসুবিধা হল। গরমও খুব । তাই এখানে চলে এলাম ।
আমি - হ্যাঁ এখানে মানুষজন ভালো করে কথা বলে । দরকারে সাহায্যও করে । আচ্ছা আপনি বলছিলেন , আপনাদের আপেল বাগান আছে । নিজেদের বাগান?
সুজন - নিজেদেরও আছে , আবার কেনা বাগান ও আছে ।  ১ বছর বা ২ বছরের জন্য বাগান কিনতে পাওয়া যায় ।  আপেল এক বছর ফলে , পরের বছর ফলে না ।
আমি - আপেল গাছ থেকে আপেল কি হাতে করে পাড়েন?
সুজন - হ্যাঁ, ছোট গাছ হয় । হাতেই পাড়া হয় ।
আমি - এক বছর আপেল হয় অন্য বছর হয় না , তবু আমরা প্রতি বছরই আপেল পাই । কি করে?
সুজন - আমরা স্টোর করে রাখি ।
আমি - আপনার কোল্ড স্টোরেজ আছে?
সুজন - না না , আমাদের ওখানে তো খুব ঠাণ্ডা , শীতে বরফ পড়ে , তাই স্টোরেজ লাগে না । কাঠের ঘরের ছাউনি বানিয়ে রাখি , যাতে বরফ না পড়ে ।
আমি - ঐ আপেল কি কোন জুস কোম্পানি নিয়ে যায়?
সুজন - হ্যাঁ নিয়ে যায় , যে সব পাকা  আপেল গাছ থেকে পড়ে ফেটে যায় , সেগুলোকে আলাদা বস্তায় ভরে , জুস কোম্পানি নিয়ে যায় ।
আমি - ওখানে আর কি চাষ হয়?
সুজন - সবই কম বেশি হয় , ধান গম ও হয় । আখরোট, পিস্তা, বাদাম (আল্মনড ) , পেয়ারা সব হয় ।  আমি দুই বছর  কোলকাতায় গেছি আপেলের ব্যাবসা করতে । 
আমি - আচ্ছা ।  আর কদিন পরেই চলে যাবেন । আপনার মতো বাড়ির সবাইও আপনার জন্য আপেক্ষা করছে নিশ্চই ।
সুজন - হ্যাঁ , এখানে কে আছে বেটি, আপনজন বন্ধু সবই তো ওখানে। নিজের জায়গা ছেড়ে থাকতে কি ভাল লাগে?
আমি - জানি , আমার বাবা মা , বছরে একবার আমাদের কাছে আসেন , তাদের চোখে মুখেও আমি এই কষ্ট দেখি ।

বুঝছিলাম,  সুজনের মনের মেঘ একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে , এমন সময় আমার বাম দিকের বেঞ্চ থেকে ইংরিজিতে একটা প্রশ্ন এল ...

 -তোমার নাম কি?

মুখ ফিরিয়ে দেখি, সেই ভদ্র লোক , যিনি আমার সামনে সামনে জগিং করছিলেন । কখন যেন এসে আমাদের পাশের বেঞ্চে বসেছেন । তিনি তাঁর নাম বলে সেদিন নিজের পরিচয় দিলেও, আজ কিছুতেই তাঁর নাম মনে করতে পারলাম না , তাই তাঁর নাম দিলাম সৃজন , কারন তাঁর সাথে কথা বলে তিনি যে জীবনে খুব সফল তা বুঝেছিলাম ।

আমি - আমি মৌমিতা 
সৃজন- আমি  মিস্টার আর এস স্বামিনাথন । (নামটা আমার বানানো , কারন আমি ভুলে গেছি আসল নাম  । )
আমি - আচ্ছা । আপনি হিন্দি বোঝেন ?
সৃজন - না , ইংরেজি আর তামিল ।
আমি - আচ্ছা । (বুঝলাম উনি তামিলনাডু থেকে এসেছেন )। এর পর ওনার সাথে ইংরাজিতেই কথা হল ।
সৃজন - কোন কোম্পানিতে কাজ করো তুমি ?
আমি - আমি আমার নতুন এবং পুরনো কোম্পানি সম্বন্ধে যথেষ্ট খবর দিলাম ।  কোথায় কোম্পানি , কতো দিনের পুরনো কোম্পানি। কোম্পানি কি কাজ করে । এই সব ।
সৃজন - আমি চাকরি করতাম , রিটায়ার করেছি । আমার স্ত্রী রিটায়ার প্রফেসর । আমার ছেলে মেয়ে ,জামাই বউমা সবাই ইউ এস  এ তে সেটেলড ।  ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে মেয়ে ।
ছেলে মেয়ে কোন কোন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে তাও বললেন ।
আমি- হাসি মুখে বললাম ,  আচ্ছা।

সৃজন কিন্তু চুপ  করে থাকলেন না । তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেন। আমি কতো দিন এখানে আছি । আমার কাজের ডোমেইন কি । কার সাথে থাকি । নতুন অফিস কিভাবে যাই ।

আমি তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম সাথে এও বোঝালাম তাঁকে, যে আমি কেন মালটিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া সত্যেও , একটা কয়েক মাসের নতুন কোম্পানিতে ঢুকলাম । আমি আমার  কেরিয়ার নিয়ে বেশ  সিরিয়াস দেখে , তিনি বেশ খুশি হলেন ।  তাঁর পর জিজ্ঞেস করলেন ,

সৃজন - তুমি কি খুব শরীর সচেতন ?
আমি - না , খুব বেশি না , তবে কিছুটা।  আমার পায়ে বাথ্যা আছে তাই জোরে হাঁটতে পারি না ।
সৃজন - আমার বয়স ৬৫ , এই পার্কের আমি ১৫ বার চক্কর লাগাই ।
আমি-  (বুঝলাম তিনি কি শুনতে চান ) ওহঃ , আপনাকে দেখে মনেই হয়না আপনার বয়স ৬৫ ।
সৃজন - তুমি ধীরে হাঁটো, জগিং করার দরকার নেই ।
আমি - আচ্ছা ।

সৃজন বেশ খুশি হলেন ।  এমনি সময় আমায় চমকে দিয়ে , সুজন পেছন থেকে  মিষ্টি হেসে, ‘আমি চলি বেটি’ বলেই উঠে দাঁড়ালেন । আমার ‘আচ্ছা’ বলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না । অন্য দিক থেকে সৃজন ও বললেন ‘ওকে মৌমিতা , নাইস টু  মিট ইউ’ ।  আমি বললাম ‘সেম টু ইউ স্যার’ ।

সুজন সৃজন দুজনেই চলে গেলেন । আমি একা বসে থাকলাম পার্কের বেঞ্চে । 

সৃজন এই পৃথিবী অনেক দেখেছে । কিন্তু সুজন , তার দেখা কি আজকাল পাওয়া যায় সহসা ? এমন এক মানুষ যার মনের পবিত্রতা তাঁর মুখে চোখে শরীরে ছাপ রেখে গেছে । সিদ্দিক কাকুর পর ,এমন মানুষ আমার আর চোখে পড়েনি ।  আজ মন বলছিল এমনই কেও ছিলেন তিনি ।  কতো কথা বলার ছিল , কতো কথা শোনার ছিল , জানার ছিল , বাকি থেকে গেল সবই ।  মনটা উদাস হয়ে গেল ।  মুহূর্তের বর্তমান মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায় ।  এক সুজনের সাথে দেখা হল, সে কথা আমি কখনও বলতে পারব না । বলতে হবে দেখা হয়েছিল , কথা হয়েছিল । এভাবেই ছোট ছোট স্মৃতি নিয়ে এই শহরও পুরনো হতে থাকবে । আর আমি চলব বর্তমানে , আবিষ্কার করব নতুন নতুন সুজনের । 

                                    আজই তোমার দিন, বেঁচে নাও ক্ষণ ।
                                    কাল ছিল , কাল হবে , বদলাবে সন ।।
 
মৌমিতা সাহু , ব্যাঙ্গালোর

২০/০৬/২০১৬

2 comments:

  1. Lekha pore mone hochhe tui likhte Paris...amar toh khub bhalo legechhe. . . bishes kore picturization ta clear. Parbi kichhu korte.very good writing... Continue it

    ReplyDelete
  2. Tumi porecho , etei ami khusi :)

    ReplyDelete