Saturday, 16 January 2016

কাজ

লাল মোরাম রাস্তার এপারে একতলা একটা পাকা বাড়ি, আর ওপারে একটা খড়ের ছাওয়া ঝুপড়ি ঘর । মা, বাবা আর ছোট্ট ভাই এর সাথে আমি সেই একতলার বাড়িটায় ভাড়ায় থাকতাম  আর উল্টো দিকে বৌমা তার অসুস্থ ছেলে, ছোট্ট মেয়ে আর স্বামীর সাথে থাকতো । বাবার বৌমা তাই আমি আর ভাই দুজনেরও বৌমা । শুধু মায়ের কাজলদি ।  

১৯৯৩ সাল, আমার তখন সাড়ে চার বছর বয়স, আর ভাই এক মাসের মা ভাইকে নিয়ে মামাবাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই বৌমা আমাদের ঘরে আসা শুরু করে, মা কে কাজে সাহায্য করতে। স্বামীর একার উপার্জনে সংসারের খরচ খরচা কুলিয়ে উঠত না, তাই বৌমা আর পাঁচটা বাড়ির কাজ করে কিছু বাড়তি উপার্জন করত । ধরা বাঁধা বাড়ির কাজ ছাড়াও অনেকের অনেক কাজ করে দিতো । কারো বাড়ির ধান সেদ্ধ, কারো মুড়ি ভাজা, কারো পাকা তেঁতুল ছাড়ানো, শীতের সকালে নকশা বড়ি দেওয়ার জন্য বিরি কলাই বেটে দেওয়া  কেউ কেউ পুরনো শাড়ি ধুতি দিয়ে যেত, কাঁথা বানানোর জন্য। দুর্গা পুজার আগে কারো মাটির বাড়িতে সাদা মাটি আর গোবর দিয়ে নাতা দিতো ।

আমাদের পাড়ায় একজন পুলিশ ভাড়ায় থাকতেন। থানার ওয়ারলেস অপারেটার ছিলেন।  নাম মনে নেই ।  পদবি ছিল বেদান্ত। আমাদের ছোটোদের পুলিশ জেঠু । জেঠুও বৌমাকে বৌমা বলতেন ।  বৌমা পুলিশ জেঠুর জন্য রান্না করে দিতো। রোজ একই রান্না হতো। কিছু রুটি আর সব রকম সবজি দিয়ে একটা তরকারি । বৌমার শুকনো পাতার জ্বালানীর উনুনে রুটি প্রায়ই পুড়ে যেত । সেই পোড়া রুটি খেতে জেঠু খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, রুটি পোড়া খেতেই নাকি বেশি ভালো। আর আমার ভাই, তার তো বৌমার ঘরের  শুকনো রুটি একটু গুড় বা এক চামচ ডাল আর একটু আলু মাখা দিয়ে ভাতই বেশি পছন্দ ছিল ।

এতজনের মাঝে মা আর বৌমার সম্পর্কটা একটু আলাদা ছিল ।  সব ঘরের কাজ শেষ করে বৌমা আমাদের বাড়ি আসতো । কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতো । ভাইকে সরিষার তেল মালিশ করতে করতে ছড়া কাটত  আড়ে বাড়ে লম্বে বাড়ে , সরস্বতীকে নম করে  ভাই বৌমার কোলে কোলেই বড়ো হয়েছে । সকালে বিকালে রাস্তার ধারে সরকারি টাইম কল থেকে জল তোলা, কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলত । তার পর সন্ধ্যা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের ঘরে চলে আসত  মাও আপেক্ষা করত তার কাজলদির জন্য ।  আমাদের বাড়িতে চায়ের চল ছিল না, কিন্তু মায়ের কাজলদির জন্য হত । আর সাথে শুকনো মুড়ি । মুড়িতে কখনো চানাচুর কখনো ঘিয়ের চড়া আর চিনি মেশানো থাকতো । আমি আর ভাই ও বৌমার সাথে খেতে বসে যেতাম । আর সবাই মিলে টিভিতে জন্মভুমিসিরিয়াল দেখতাম । চা খাওয়ার কাঁচের গ্লাস গুলো ধুতে গিয়ে মাঝে মধ্যে সেগুলো ভেঙে যেতো । তখন বৌমা বলতো দিদিগো, হায় তোমার একটা গ্লাস ভেঙ্গেইছে  মা বলতো সে ভাঙ্গুক, আপনার হাত কাটেনিতো ’? মা আর বৌমার মধ্যে কাজের লোক আর মালিকের তো কোন সম্পর্কই ছিল না, বরং পাড়ার অন্যান্যরা এই ভালবাসা দেখে হিংসে করত । কেউ কেউ বলতো মৌয়ের মা এর কাছে গেলে তুমি তো আসতেই চাও না কাজলদি।বৌমা সে সব কথায় খুশি হয়ে হাসত।  

বৌমার সাথে তার বাপের বাড়ি আমি ও ভাই বেশ কয়েকবার গিয়েছি । বৌমার মুখে তার ছোটবেলার গল্প অনেক শুনেছি । চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার বাড়িতে ছিল সে। বাবার খুব আদরের ছিল সে বৌমার মুখেই শুনেছি তার বাবা নাকি গুনিন ছিলেন। ঝাড় ফুঁক মন্ত্র দিয়ে ভূতকে কব্জা করতে পারতেন । ঘোড়া ভূত, গোমুখা ভুত, কুন্দ্রা ভূত, স্কন্ধ কাটা ভূত, সুপুরষা কুপুরষা, শাকচুন্নি, পেত্নী কিংবা হনুমান ভূত সব তাঁর মন্ত্র দেওয়া সরিষায় কাবু হত । ঘোড়া ভুত আসলে শুধু চিঁহি চিঁহি ডাক আর ঘোড়া খুরের তগবগ শব্দই শোনা যায়। তাকে দেখা যায় না । কুন্দ্রা ভুত হল পোষা ভুত। মনিব যা বলে সে তাই করে। স্কন্ধ কাটা ভূতের মুণ্ডু থাকে না। শুধু ধড়টাই থাকে। তাই সেই ভুত কিছু দেখতে পায়না । কিন্তু সে সব কিছু জড়িয়ে ধরতে চায় । যদি একবার কাউকে জড়িয়ে ধরে তার আর নিস্তার নেই। গোমুখা ভুত আবার খুব অদ্ভুত, সে কখনো সাদা বাছুরের রূপ নেয়, কখনো গরুর রূপ নেয়, কখনোবা গোবরের রূপ নেয়। বৌমা বলে, কেউ যদি সেই গোবর ডিঙ্গিয়েছে তার আর নিস্তার নেই ।  সব গল্প শুনে শুনে , সেই সব জায়গা দেখার খুব ইচ্ছে হতো । বৌমার বাপের বাড়ি গেলে সারা দিন পুকুর পাড়ে, মাঠের ধারে , বনে জঙ্গলে ঘুরে, পুকুরে স্নান করে , মাছ ধরা দেখে কেটে যেত । সন্ধ্যে বেলা ঘরের বাইরে পরিস্কার নিকানো উঠোনে মাদুর পেতে আমরা সবাই ছোটরা বসতাম বৌমার মায়ের চার পাশে । ভুতের গল্প শুনতে । কিন্তু দিদা বলত, আজকাল আর সেরকম ভূত এর উৎপাত নেই। ভূত আজ কাল দেখাই যায় না । কি আর করা যাবে । তাই বৌমার কাছে সেই সব গল্প ঘুরে ফিরে শুনতাম , আর দূরে মাঠের ওপারে রাতের আন্ধকারে ট্রেন ছুটে যেতে দেখতাম ।

পড়াশুনা খেলাধুলা ভুতের গল্প এই সব নিয়েই বেশ কাটছিল দিন গুলো । সালটা ২০০০ বা ২০০১ হবে । আমরা তখন একই পাড়াতে অন্য একটা বাড়িতে ভাড়ায় থাকি । বৌমা আমাদের বাড়িতে তখন আর কাজ করে না । ভাই বড়ো হয়ে গেছে । ঘরের সব কাজ মা একা সামলে নিতে পারে  কিন্তু তাতে মা আর বৌমার সম্পর্কে কোন পরিবর্তন আসেনি । ভালো মন্দ কিছু হলেই বাটি ঢাকা দিয়ে সেটা এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যেত । কাজলদি বললেই বৌমা হাজির । মা যেখানেই যাক, কারো জন্য কিছু আনুক চাই না আনুক , হাতে কাজলদির জন্য কিছু থাকবেই । ভাই বাড়িতে না থাকলে নিশ্চয়ই বৌমার ঘরে থাকতো, ওটা ওর যাকে বলে সেকেন্ড হোম।

একদিন হঠাৎ, সন্ধ্যের দিকে বৌমা মাকে খুব গালা গালি দিতে শুরু করল । সে কি ভীষণ ভাষা । তাঁর আগে বৌমাকে ওভাবে চিৎকার করতে শুনিনি । খুব শান্ত স্বভাবের ছিল । স্বামীর ওপর রাগ হলেও, মাকে এসে বলতো, ‘গাল দিয়ে কি হবে দিদি?’ সেই বৌমা যে মাকে ওভাবে গালাগাল করতে পারে তা আমাদের কল্পনার অতীত ছিল । আর মা, একটা শব্দও করলেন না । বললেন, ‘কোন কারনে মাথা খুব গরম হয়ে গেছে, তাই ওরকম বলছে, কাল মাথা ঠাণ্ডা হলে, নিজেই আসবে। এখন কিছু বললে কথায় কথা বাড়বে। না, পরের দিন বৌমা আসেনি, মাও কখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু, দুঃখের কথা বৌমার গালাগালি দেওয়া বন্ধ হল না । শুধু মাকে না, যখন তখন যাকে তাকে গালি দিতে শুরু করল । কোন কারন নেই তাও । একদিন বিকেলে পাড়ার একজনের হাতে বৌমা একটা পোস্ট কার্ড সাইজের ছবি পাঠিয়েছিল। আর বলেছিল, ‘দিদি কে দিয়ে বলবি, আমি হারিয়ে গেলে এই ছবি দেখিয়ে যেন খুঁজে আনে। সব চেয়ে অবাক ব্যাপার হল, ছবিটার পেছনে বৌমা নিজের হাতে নিজের নাম সই করে দিয়েছিল। শ্রীমতী কাজল রানা । এতিদিনেও জানতাম না যে বৌমা লিখতে পড়তে পারে । মাও অবাক হয়েছিল । ছেলে মেয়ে বড় করতে করতে, সংসারের বোঝা বইতে বইতে , মনের কষ্ট দুঃখ সেভাবে কখন প্রকাশ করতে পারেনি । এক সময়, তার শরীর আর সেই বোঝা টানতে পারছিল না । চিন্তা শক্তি, বোধ বুদ্ধি বিচার ক্ষমতা হারাচ্ছিল ধিরে ধিরে । আমার মনে হয়, রাগ, ঘৃণা সব মনে ছিল আর কাছের মানুষ হিসেবে , বন্ধু হিসেবে, যে মানুষের ছবিটা মনে আসছিল সেটা মা ছিল । মস্তিষ্ক কাজ না করায়, মায়ের ওপরেই রাগ দেখিয়েছিল সেদিন । পরে হয়তো মনেই ছিল না, যে সে এরকম কিছু বলেছিল । তাইতো সেদিন , নিজের হারিয়ে যাওয়ার অজানা আশঙ্কায়ও মাকেই তার মনে পড়েছিল, বন্ধু হিসেবে।

দুই তিন বছর এমনিই কাটল। কিছু ডাক্তার দেখানো হল । তখন বৌমা আর চিৎকার করতো না । সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বকত। কখন ব্যক্তি বিশেষ, কখনো বস্তু বিশেষ, কখনো নিজেই নিজের বিষয় বস্তু এতো কিছুর মাঝেও তার কাজ কিন্তু থামেনি। মনের ভেতর, মাথার ভেতর সব উল্টে পাল্টে গেলেও, কি কাজ কখন করতে হবে সেটা সে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। লোকজন চিনতে ভুল হত না, হিসেবে ভুল হত না , রাস্তা চিনতে ভুল হত না, এমনকি রান্নার নুন মশলাও একদম ঠিক করে দিত। তাই অনেকেই ভাবত সে এইসব জেনে বুঝেই করছে।  

আমরা নিজেরদের নতুন বাড়িতে চলে এসেছিলাম । পুরনো পাড়া থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে । মা সব সময় তার কাজলদির খোঁজ রাখত । দেখা নেই কথা নেই তাও খোঁজ ঠিকই রাখত । মা কখনো বোধ হয় বৌমার ওপর রাগই করেনি । একদিন বিকেলে হঠাৎ বৌমা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির । কিছুক্ষণ বসল , দিদি দিদি করে গল্প করল । চা খেল, আপন মনে কথা বলল কিছুক্ষণ। কিছু জিজ্ঞেস করলে কোন কথার সঠিক জবাব দেয়, কোন কথার দেয় না। কোন প্রসঙ্গ থেকে কোথায় চলে যায় এক মুহূর্তে বোঝার উপায় নেই । তার পর চলে গেল । সে দিনের পর থেকে বৌমা মাঝে মাঝেই আসে । কখনো কখনো খাওয়ার নিয়েও আসে ।

আজকাল বৌমা আর তেমন বকবক করে না । অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে । বয়স হয়ে গেছে । কোমরটা একটু বাঁকার দিকে । রোগা হয়েছে । শরীর আর কাজের বোঝা বইতে পারছে না। তাও কাজ করে চলে । ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, এ কাজ, সে কাজ। রাস্তার ওপারের একতলা বাড়িটা এখন চার তলা হয়েছে ।  এখনও সেই বাড়ির, কারো কারো টুকি টাকি কাজ করে দেয় বৌমা বৌমার বাড়ি  যাওয়া হয়না অনেক দিন। শেষ বার যখন বাড়ি গেলাম, পুজার সময়, বৌমা একবার দুধ পিঠা, একবার লুচি মাংস করে নিজে দিতে এসেছিল । এসেই চলে গেল । সেবার গেলাম বৌমার ঘরে একদিন আমি আর ভাই গিয়ে দেখলাম, বাঁশের বেড়ার জায়গায় ইটের তৈরি দেওয়ালের ঘরে সে থাকে বটে, কিন্ত, তাতে তার নিজের অবস্থার পরিবর্তন হ্য়নি বিন্দুমাত্র । তেইশ বছর আগেও যা ছিল , আজও তাই আছে ।

হাসি মুখে জীবনের দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেল একদিন, রাগে দুঃখে আভিমানে গালাগালি দিয়ে সেই দুঃখকে তাড়াতেও চেয়েছিল, কিন্তু হায় পারেনি সে। দুঃখ হার মানেনি যে , ছেড়েও যায়নি তাকে। তাই বুঝি আজ সে এত শান্ত । দুঃখের সাথে পাশাপাশি থাকে, হাসে না কাঁদে না, মান নেই আভিমান নেই। এখন বুঝি বেঁচে থাকাটাও তার কাছে একটা কাজ । তাই মুখ বুজে সেই কাজ করে চলেছে সে।         

            -Moumita Sahu


2 comments:

  1. Tor life er ei chhoto khato jinis gulo diye khub sundar galpo bandhate sikhe giyechhis.. Porar por jeno amio oi jagat ei chole gelam kichukkhan er jonno. Boi lekha suru kor ebar.. Anek garbo bodh korchhi j amar emon ekta lekhika bandhobi achhe..

    ReplyDelete