ন্যাশানাল হাইওয়ে সিক্স , কলকাতা থেকে মুম্বাই যাওয়ার জাতীয়
সড়ক । সবাই সাধারণত বোম্বাই রোডই বলে। এটা আমাদের বাড়ি
থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দুর দিয়ে গিয়েছে । এই চল্লিশ কিমি এসে বোম্বাই রোড ধরে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে
হয় আরও কুড়ি কিলোমিটার। জায়গাটার নাম বসন্তপুর । কেউ বলে, অকড়া বসন্তপুর। আবার কেউ কেউ শুধুই
অকড়া বলে । এই বাস স্ট্যান্ড এর সব চেয়ে কাছের গ্রামের নাম সুলতানপুর । তাই বাসে,
সুলতানপুর বললেও চলে । সুলতানপুর যেতে হলে, বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হতে হয় । সুলতানপুরের
চৌধুরিদের বাড়ি বললে যে কোন রিক্সা ওয়ালা নিয়ে যাবে । ধান চাষের জমি, গাছগাছালি
ঘেরা ছোট বড় মাটির , ইটের বাড়ি পেরিয়ে, বড় শ্মশান আর শিব মন্দির এসে পড়লেই বুঝবে,
পৌঁছে গেছি ।
এই চৌধুরীদের বাড়িতে চার ভাই এর বাস । বাড়ির সবাই খুব ভদ্র, নম্র ও শান্ত স্বভাবের । চার ভাই তাদের
নিজের নিজের পরিবারের সাথে ছাদের তলায় আলাদা আলাদা সংসার করে । তবে সেটা খাওয়ার
সময় ছাড়া খুব একটা বোঝার উপায় নেই । কারন তাদের রান্না ঘর টুকুই শুধু আলাদা, মন
গুলো সব এক । এক টুকরো
মাছও কিভাবে তিনজনকে ভাগ করে, হাসি মুখে সম্মানের সাথে খেতে দিতে হয় তা এই
পরিবারের গৃহিণীরা খুব ভালো ভাবেই জানত । শুনেছি আমার বাবা এবং এক কাকা এক সময়
এদের বাড়িতে থেকে বাচ্চাদের টিউশান পড়াতেন । তাই এদের বাড়ির সবাই বাবাকে ‘মাস্টারমসয়’
বলে ডাকত । সে আমার জন্মের অনেক আগের কথা । তবে সেই থেকেই আমাদের
পরিবার আর এই চৌধুরী পরিবারের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আমার জন্মের পর থেকে মা
বাবার সাথে আমারও যাতায়াত শুরু হয় এই বাড়িতে ।
বড় ভাই শ্রী মদন চৌধুরী। বসন্তপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে বোম্বাই
রোড পেরিয়ে গলির মোরাম রাস্তা ধরে একটু এগোলেই তার সাথে দেখা হবে । সেখানেই
রাস্তার ধারে একটা পানের দোকান আছে তার । স্ত্রী লতিকার, ঘরের কাজ থেকে মুহূর্তের
বিরাম নেই। দুই ছেলে দেবাশিস আর প্রেমাশিস । দেবাশিস বড়, প্রেমাশিস ছোট । আর এক
মেয়ে শিখা । এছাড়া মেজ ভাই এক ছেলে আশিস আর তার স্ত্রীর সাথে থাকে। সেজ ভাই এর দুই
ছেলে । লেলু আর ফেলু । কেউ কেউ লালা ফেলা বলেও ডাকত । এই লেলু আর ফেলু আমার চেয়ে
কয়েক বছরেরই বড় ছিল । তাই ওখানে গেলে সারক্ষণ ওদের সাথে ঘুরে বেড়ানোই আমার একমাত্র
কাজ ছিল । প্রেমাশিস দাদা, লেলু আর ফেলু আমাকে বনু বলে ডাকত । এতো মিষ্টি করে আর
কেউ কখনো আমাকে বনু বলে ডাকেনি । আর একটা ব্যাপার হল এদের বড় ভাই আর সেজ ভাই দুই
আপন বোনকে বিয়ে করে । লতিকা আর মলিনা । তাই এই দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক আরও
বেশি ভালো ছিল । ছোট ভাইয়ের তিনটি মেয়ে । তার মধ্যে বড় আর মেজও আমার খেলার সাথি
ছিল ।
আমরা মুলত বড়র মানে মদন জেঠুর বাড়িরই অতিথি ছিলাম । আমরা
গেলে মলিনা মাসিদের আর লতিকা জেঠিমাদের রান্না একসাথে হত । সকালে আমার ঘুম থেকে
ওঠার আগেই লেলু আর ফেলুর লেখাপড়া শেষ হয়ে যেত । তার পর তাদের সাথে পাড়ার এদিক সেদিক ঘোরা, নদী পাড়ে ধুরতে
যাওয়া, কাঁচা টক কুল, কাঁচা পেয়ারা পাড়া এই সব করে দুপুর হয়ে যেত । দেবাশিস দাদা
ছাড়া লেলু ফেলু যমকেও ভয় পেত না । তাই দেবাশিস দাদা বলার আগেই স্নান আর দুপুরের
খাওয়াটা সেরে ফেলতে হত । খাওয়ার পর ঘুমনোর অনেক চেষ্টা করেও যখন ঘুম আসতো না তখন
সকলে লুডো বা সাপ সিঁড়ি খেলতে বসতাম । কোন কোন দিন বিকেলে মায়ের সাথে কংসাবতীর
বেড়াতে চরে যেতাম। সেখানে নদীর ওপারের সবাই আসতো আমার আর মায়ের সাথে দেখা করতে ।
সাথে পিঠে, দুধ, নারকেল, নারকেল নাড়ু, তাল শাঁস নিয়ে আসত । নদীর ওপারে আমাদের
দেশের বাড়ি, ধর্মপুরে । সেখানে আমাদের যাওয়া মানা ছিল, বড়দের কোন এক বোকা বোকা মান আভিমানের কারনে। মা
বলে আমি যখন এক বছর নয় মাসের তখন আমাকে নিয়ে বাবার কাছে চলে আসে বাবার কাজের
জায়গায় । তার পর থেকে আমি আর মা সেখানকার পাড়ার জেঠিমা কাকিমা , দাদা দিদিদের সাথে
নদীর চরেই দেখা করতাম । সারা বিকেল নদীর বালি ঘেঁটে ঘেঁটে, সন্ধ্যার সময় আবার ফিরে
আসতাম মদন জেঠুদের বাড়িতে । সারা দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ত সবাই । আমরা ছোটরা একটা ঘরে মলিনা মাসির সাথে ঘুমোতাম । দু তিনটা মাদুর
একসাথে পেতে লাইন দিয়ে বালিশ দেওয়া হত । সকালে উঠে দেখতাম আমি বিছানায় একা, বাকি
সবার ঘণ্টা তিনেক আগেই সকাল হয়েছে ।
সালটা ১৯৯৫ কি ১৯৯৬ । বোম্বাই রোড তখনও ওয়ান ওয়ে হয়নি ।
বোম্বাই রোড ওয়ান ওয়ে হওয়া শুরু হয়েছিলো ১৯৯৮ এর পর, বাইজপেই এর সময় । একটাই
রাস্তায় বড় বড় মাল বোঝাই লরি, বাস , ট্যাক্সি, মারুতি, মোটর সাইকেল সব ছুটছে ।
রাস্তার বাম দিক ধরে গাড়ি গুলো দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে আর
ডান দিক দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে । সেসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পেরতে হতো । আমাদের
বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে একটা কলেজ আছে । প্রেমাশিসদা সেই কলেজে ভর্তি
হয়েছিলো । সে রোজ বাড়ি থেকে এতো দূরে কলেজ করতে আসতো । সকাল থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যে বেলায়
ফেরা । তাই, এই রাস্তা পেরিয়ে বাসে চড়া, বা বাস থেকে নেমে রাস্তা পেরনো তার রোজকার
জীবন যাপনের অংশ ছিল। মাঝে মাঝেই শনিবার ক্লাস শেষে আমাদের বাড়িতে থেকে যেত ।
একেবারে সোমবার ক্লাস করে বাড়ি ফিরত । সেরকমই এক শনিবার, সকাল ১০ টার কাছাকাছি,
রান্না ঘরে মা রান্নায় খুবই ব্যাস্ত । আমি মায়ের কাছেই কিছু একটা করছিলাম । বাবা
বাথরুমে স্নানে গেছেন । রোজকার মতো বাবা স্নান সেরে বেরলেই মা খেতে দেবে । আর আমি
বাবার সাথে এক থালায় খেয়ে, বাবার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাব । হঠাৎ বাবার স্কুলের একজন
অশিক্ষণ কর্মী মানে সহজ ইংরেজিতে যাকে বলে নন-টিচিং স্টাফ সাইকেল নিয়ে হাজির। সবাই
তাকে হাওড়া বলেই ডাকে, ভালো নাম তপন । তখন হাতে হাতে মোবাইলতো দুরের কথা, বাড়িতে
বাড়িতে ল্যান্ড লাইনও ছিল না । আমাদেরও ছিল না । আমাদের ল্যান্ড লাইন হোল, ১৯৯৮ এর
শেষের দিকে বা ১৯৯৯ এর শুরুতে । সে যাই হোক , তাই আমাদের যে কোন ফোন আসত, হয় বাবার
স্কুলে, নয়তো আমাদের পাশের বাড়িতে । তা সেদিন ফোনটা এসেছিল স্কুলের ফোনে । স্কুল
যাওয়ার ঠিক আগে স্কুলের কারো বাড়িতে আশা দেখেই মা বুঝেছিল কিছু জরুরি ব্যাপারেই
এসেছে । মা জিজ্ঞেস করায়, তিনি বললেন, বসন্তপুর থেকে ফোন এসেছিল । প্রেমাশিস নামে
কারো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মারা গেছে। বাবা পড়িমরি করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভালো করে
জিজ্ঞেস করে বুঝলেন, নাম বা জায়গা কোনটাই শুনতে সে ভুল করেননি । সঙ্গে সঙ্গে বাবা
মা আর ছোট্ট ভাই এর সাথে পৌঁছলাম সেখানে ।
সেদিনের ছবি এখনও
আমার চোখে ভাসে । কেউ দাওয়ায় মাটিতে বসে, কেউ বারান্দার সিমেন্টের খুঁটি ধরে
দাঁড়িয়ে । কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, কেউ বা ফিস ফিস করে কথা বলছে আবার কেউবা বোবার
মতো চুপ করে আছে । টুকিটাকি কথাবার্তায় জানা গেল, সেদিনও সে অন্যান্য দিনের মতো
সকালে স্নান সেরে খেয়ে বেরিয়েছিল কলেজ যাবে বলে । আর বলেছিল, কলেজ শেষে আমাদের
বাড়িতেই থাকবে । ফিরবে সোমবার ।
ওদের ঘরে ঢুকলেই বাম দিকে ছোট্ট একটা বৈঠকখানা, তার পর একটা
ঘর , আর সামনে টানা বারান্দা শেষ হয়েছে রান্না ঘরের দরজায় । টানা বারান্দার কোন বড়
জানালা ছিল না । তাই ভেতরটা দিনের বেলাও বেশ অন্ধকার লাগত । বারান্দার ডান দিকে,
ওপরে, সব সময় একটা বাঁশ বাঁধা থাকত । সেটাতে বাড়ির সকলের নিত্য পরা জামা কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হত । সেদিন গিয়ে আমি ঘরের এদিক ওদিক ঘুরছিলাম । জেঠিমা
পাগলের মতো কাঁদছে । মলিনা মাসির কেঁদে কেঁদে চোখ লাল । কাপড়টা মুখে চেপে ধরে ফিস
ফিস করে একে ওকে সকালে প্রেমাশিসদা কি কি করেছিল, কি কি বলেছিল, সেই সব বার বার
বলছে, আর চোখ মুছছে । ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই বাঁশটার দিকে চোখ পড়ল আমার, দেখি সেখানে
প্রেমাশিসদার ঘন নীল রঙের ওপর খুব পাতলা সাদা চেকের জামাটা তখনও ঝুলছে । শেষবার সে, সেটা
পরেই এসেছিল আমাদের বাড়ি । রোগা , ৫’৩’’ হাইট হবে খুব জোর । ধারালো মুখটা মনে পড়ল । সেই নীল জামা পরেই শেষ বার দেখেছিলাম তাকে । বিশ্বাস হচ্ছিল না,
সবাই তার মর দেহ আশার আপেক্ষা করছিল । তাকে যখন আনা হল তখন বেলা পাঁচটা মতো । ততক্ষণে কি করে কি
হয়েছিল সে সবও জানা হয়ে গিয়েছিল ।
ভাত খেয়ে সাইকেল
নিয়ে সে তাড়াতাড়ি পৌঁছায় বসন্তপুর বাস স্ট্যান্ডে । পেনের কালি শেষ হয়ে গেছিল। বাস
আসতে মিনিট ৫ দেরি দেখে, রাস্তার ওপারে একটা দোকান থেকে পেনটা রিফিল করাতে যায় সে
। সেখান থেকেই খেয়াল করে , বাস চলে এসেছে । বাস ছেড়ে যাবে এই চিন্তায় , গাড়ি না
দেখেই রাস্তা পার হচ্ছিল সে । প্রায় রাস্তা পেরনোর মুখে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাওয়া
এক বিশাল মাল বাহি ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারে তাকে । অনেকটা দূরে লাল ছোট ছোট কঠিন
বোলডারের ওপর ছিটকে পড়ে তার শরীরটা । ডান গালে একটা পাথরের টুকরো ধুকে যায় । আশেপাশের লোকজন সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে
তাকে ভ্যান রিকশার তোলে । সামনে ৫০০ মিটারের মধ্যে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার
পথে একবার বমি করে সে । সকালের সব খাওয়ার বেরিয়ে যায় । আর তার পর সব শেষ ।
ইন্টারনাল হেমারেজ । মৃত দেহ আনার পর দেখলাম ডান গালে একটা গর্ত । আর পুরো শরীরে
তেমন আধাতের দাগ নেই । ময়না করার জন্য, পুরো কপাল আর বুকটা কাটা হয়েছে , আবার
সেলাই করে দেওয়া হয়েছে । জেঠিমাকে ছেলের মৃত দেহ থেকে সরানো যাচ্ছিল না । কোন
ক্রমে তাকে সরিয়ে , দেহ নিয়ে সকলে চলে গেল শ্মশানে ।
এর পর আমি যতবার শ্মশানের পাশের রাস্তা দিয়ে জেঠুদের বাড়ি
গিয়েছি ততবারই সেখানকার পড়ে থাকা কালো কালো পোড়া কাঠ , বাঁশ , পোড়া কাপড় দিয়ে
বোঝার চেষ্টা করেছি, ঠিক কোনখানটায় প্রেমাশিসদাকে পোড়ানো হয়েছিল । মাও জানতো না ।
নাহলে মা ঠিকই দেখাত । আমার জানার প্রবল ইচ্ছে হত কারন , জেঠিমা তার ছোট ছেলের
মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি । প্রায় পাগল হয়ে গেছিল । মাঝে মাঝেই শ্মশানে চলে আসত আর ছেলের চিতার চাই ভস্ম গায়ে
মাখত । কেঁদে
কেঁদে না খেয়ে না ঘুমিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ত । শরীর কঙ্কাল সার হয়ে পড়েছিল ।
এই ঘটনার প্রায় ৭ বছর পর শিখাদির বিয়ে ঠিক হয়। অনেক দিন পর
সেখানে গিয়ে আবার কিছুটা খুশির মুহূর্ত কাটাই । জেঠিমা ততদিনে নিজেকে কিছুটা সামলেছে । তবে ভুল করেও তার
সামনে কেউ প্রেমাশিসদার নাম উচ্চারন করতো না । সেই বিয়েতে আমি প্রথম আমি আমার মেজ কাকু,
সান কাকিমা , আর এক খুড়তুতো ভাইকে দেখি । মেজ কাকুকে দেখতে প্রায় বাবার মতো । হাইট
একটু কম হবে । মা দুর থেকে কাকুর একটা ফটো তুলেছিল। শিখাদির বিয়ের অনেক ছবি এখনও
আমাদের অ্যালবামে আছে । তার মধ্যে মা আর দুই কাকিমার একসাথে বসে খাওয়ারও একটা ছবি
আছে । তিনজন একসাথে হাসি মুখে টেবিলে খেতে বসেছে এরকমই একটা ছবি । তিন জা এর
একসাথে কাটানো মুহূর্ত একটা ফ্রেমেই বন্দি হয়ে আছে । এই সব, কিছু ছোট ছোট জিনিস
সেদিন পেয়েছিলাম । তার পর গেছিলাম আবার প্রায় ২ বছর পর । ২০০৩ এর শুরুতে বোধ হয় । দেবাশিসদার বিয়েতে । মাসটা
জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারি । বেশ শীত ছিল । বিয়ে করাতে গিয়েছিলাম । সোয়েটার পরলে,
সুন্দর জামা দেখাই যাবে না, তাই ঐ কনকনে শীতের রাতেও সোয়েটার পরিনি । নাচা গানা হই
হুল্লোড় সবের মাঝে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছিল , জেঠিমা । যেন সে থেকেও নেই । কোন
কিছুই তাকে ছুঁতে পারছিল না ।
এর পর থেকে সেভাবে আর যাওয়া হয়নি সুলতানপুর । যোগাযোগ খবরা
খবর কমে আসছিল । একদিন শুনলাম শিখাদি, শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে । প্রায় চার
বছর সংসার করার বৃথা চেষ্টা করে , অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে ,
নিঃসন্তান শিখাদি ফিরে এসেছিল তার মায়ের কাছে । বাড়িতে তখন মা, মেয়ে আর বৌমা ।
অন্য পাঁচটা বাড়ির মতো এবাড়িতেও অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল ধিরে ধিরে । শিখাদি
মানসিক ভাবে সুস্থ ছিল না । যদিও আমি কোন দিন তার মধ্যে কোন অস্বভাবিকাতা লক্ষ্য
করিনি । সুস্থ মানুষের মতো ,তার স্নান, খাওয়া, ঘুম, কথা বলা ছিল । আমাকে কোলে
বসিয়ে ছোট বেলায় গল্প শোনাত । সেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে নিয়েই সমস্যা শুরু
হয় । আর একদিন সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু
হয় । শুনেছি হাসপাতালে আর নিয়ে যাওয়া হয়নি তাকে । আত্মহত্মা হলেও তার ময়না করা
হয়নি । সরাসরি শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তার সৎকার করা হয় । যেটা আমার বেআইনি এবং অপারাধ মূলক একটা কাজই মনে হয়েছে । আর
জানিনা, জেঠিমা তার দ্বিতীয় সন্তান শোকে কি করেছিল । দুই পরিবারের সময়ের অভাবে,
নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ততার কারনে, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এখন যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন বললেই
চলে । তাই এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারিনি ।
কিছুদিন আগে, মা বলল, জেঠিমাও চলে গেছে । একদিন সকাল থেকে
তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না । বেলার দিকে তার ঝুলন্ত নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় ছাদের
এক চিলে কোঠার ঘর থেকে । তার পর কি হয়েছে জানি না । শুধু মনে হয়েছে এই সন্তানহীন
জীবন থেকে মুক্তি নিয়েছে এক মা । যে তার আত্মজ আত্মজার অসময়ে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে
পারেনি । পার্থনা করি , যে সন্তানদের শোকে সে তার নিজের জীবনকে উপভোগ করতে পারেনি,
যেন জীবনের ওপারে সে তার সেই হারানো সন্তানদের দেখা পায়, তাদের সাথে খুশি থাকে ।
এতো কথার মাঝে যার কথা বলা হল না সে হল জেঠু, শ্রী মদন
চৌধুরী । সেও তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে হারিয়েছে । এই ঘটনা বহুল জীবনে এই সাধারণ মানুষটার মনের খবর কেউ কোনদিন
রাখেনি । হয়তো তার স্ত্রীও না । রাখলে হয়তো এভাবে শেষ বয়সে তাকে একা সঙ্গীহীন করে
স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারত না । এই মানুষটা সারা জীবন চুপ চাপ নিজের কাজ করে গেছে ।
রাগ, দুঃখ, আভিমান, প্রতিবাদ তার জীবনে নিষ্ঠুর ভাবে আঁচড় কেটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই
ক্ষত তার মনকে বিষিয়ে দিতে পারেনি । চিৎকার করে বুক চাপড়ে কাঁদেনি বলেই হয়তো সবাই
ধরে নিয়েছে সে ঠিক ছিল ও আছে । আর হয়তো তাই আমারও জেঠুর মুখের সেই মিষ্টি হাসি
ছাড়া আজ আর কিছুই মনে পড়ে না ।
মৌমিতা
সাহু
২৫/০১/২০১৬ , ব্যাঙ্গালোর
Tor life ta upannas bone jabe...Lekhoni ta Khub sundar hoyechhe..Kintu kichu jeno miss korchhi ete..
ReplyDeleteAmar nijer e kichu jinis ajana, tai kichu sunnosthan theke geche. Akhono segulo vorie felar joggota arjon korini. Sikhchi, chesta korchi. But really thanks , Feedback er jonno.
Delete