Sunday, 26 June 2016

অভিমুখ

এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের  মুখ দেখে কখনই  মনে হয় না, পৃথিবীতে এমন কি কিছু থাকতে পারে যা এই সব মানুষদের দুঃখী করতে পারে । যদি এই মানুষ দুখিও হন , তবে  সে দুঃখ  আর যাই হোক , তাঁদের মন কে অশান্ত করতে পারেনা । তাই তাদের মুখে দুঃখের কোন  ছায়া পড়ে না ।   ধরনের মানুষ কোন কিছুতেই বিস্মিত হন না , আপ্লুতও হন না , আবার ভেঙ্গেও পড়েন না । এরা নিজেদের জগতে বাস করেন । এঁরা অন্যের বাধা মানেন না , আবার অন্যকে বাধাও দেন না ।  এঁরা  নিজের মতো করে বাঁচতে ভালবাসেন, আর অন্যদের বাঁচতে দেন । 

এমনই একজনকে আমি চিনতাম ,  ছোট খাটো চেহারার মানুষটা , মাঝে মাঝেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠেন মাথা ভরা পাকা চুল ,  রোদে পোড়া , যত্ন না নেওয়া , বয়সের ভারে মলিন হয়ে যাওয়া ফর্সা গায়ের রং হাঁটুর নিচ পর্যন্ত খাটো ধুতি আর গায়ে হাফ হাতা জামা কোনটাই ধোপ দুরস্ত নয় , আবার নোংরাও বলা যায় না মনে হয় , নিজে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেন , কিন্তু এর চেয়ে বেশি পেরে ওঠেন না ।  চোখের চশমাটায় এতো বেশি পাওয়ার, যে তার চোখ দুটো খুব ছোট মনে হয় । চশমার একদিকের ডাঁটিতে সুতো জড়ানো । আর মুখে ভীষণ সরল মিষ্টি এক হাসি লেগেই থাকে । এমন হাসি মাখা মুখ মনে পড়লে , যে কোন মানুষের মনে শান্তি নেমে আসে আর অজান্তেই ঠোঁটের কোনে লাগে মিষ্টি হাসির ছোঁয়া 

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা , বছরের যে কোন সময়,  সঠিক দিন সঠিক  সময় ধরে যদি লক্ষ্য কর, এই মানুষটাকে একই সময়ে ঠিক একই জায়গায় পেয়ে যাবে তুমি । তবে, তুমি একটু দেরি করলে কিন্তু আর দেখতে পাবে না ।  সাদা প্লাস্টিকের বস্তা সেলাই করে করে মাঝারি মাপের একটা আসন বানানো, যার রং এখন ধূসর । তার পেছনের দিকে বসেন তিনি , আর সামনে রাখা কিছু চিপসের প্যাকেট , কিছু চিনির পাটালি, আর কিছু গুড়ের পাটালি । ব্যাস , আর কিছু না । যতো দিন দেখেছি এই দেখেছি । মঙ্গল বার হাটে রাস্তার এক ধারে, বা দুর্গা পূজার প্যান্ডেলের বাম দিকের এক কোনে, কিংবা গার্লস স্কুলের সাইকেল বারান্দায়, বছরের পর বছর একই ছবি মনে পড়ে ।  কখন আসেন দেখি না , কখন চলে জান তাও দেখি না ,শুধু বসে থাকতেই দেখি ।  আমরা ছোটবেলায় তাঁকে ডাকতাম ‘চিপস দাদু’।


স্কুলের সাইকেল বারান্দায় টিফিনের সময় অনেক দোকান বসত । কেউ ঘুগনি , কেউ মসলা মুড়ি  আবার কেউ ফুচকা, আবার কেউ কুলফি বিক্রি করত । তাদের আমরা খাওয়ারের নাম দিয়ে ডাকতাম । ঘুগনি দাদু, চিপস দাদু , মুড়ি মাসি এই সব ।  এই চিপস দাদুর থেকে  প্রায় আমি চিপস নিতাম । প্রতি চিপসের প্যাকেটের দাম পঞ্চাশ পয়সা । দাদু পয়সা নিতে চাইতেন না । আমি রোজ পয়সা দিতাম । কাছে গেলেই জিজ্ঞেস করতেন ‘ভালো আছো মা? মা বাবা ভালো আছেন?’ আমি মাথা নাড়িয়ে তিনি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতাম । কখনও কখনও তাঁর আসনের এক কোনে কিছুক্ষণ বসতাম, বেশি কথা হত না, তাও কেন জানি বসতে ভালো লাগতো । মনে পড়ে দুর্গা পূজার প্যান্ডেলের পাশে দেখা করতাম প্রতি বার ।  খানিক আলো আন্ধারিতে বসতেন । পুজোর প্রণাম করলেই কিছু চিপস আর পাটালি দিতে চাইতেন । কোন বার নিতাম, কোন বার তাঁর বিক্রি হবে ভেবে নিতাম না । নিলেও খুশি হতেন , না নিলেও। তাঁর দুঃখী মুখ মনে পড়ে না কিছুতেই । একদিন স্কুলে দুষ্টুমি করে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলাম । বলেছিলাম চিপস দাদুর থেকে আমি বিনা পয়সায় চিপস নিতে পারি । কেউ বিশ্বাস করল না । প্রমাণ করতে , গিয়ে বসলাম দাদুর পাশে । একথা সেকথা বলার পর বললাম , দাদু চলিগো । দাদু বললেন , কিছু নাও । আমি বললাম ,নানা । বললেন ,  নাও না । আমি একটা চিপসের প্যাকেট নিলাম । বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল , কি করে আনলি । আমি দুষ্টু চোখে হেসেছিলাম ।  সে কথা  মনে পরলে আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয় ।

বাড়িতে চীর রুগ্ন তিক্ত মেজাজের স্ত্রীর সেভাবে যত্ন করতে পারেন  না    মেয়েদের বেশি লেখা পড়া শেখাতে পারেননি । তাই মনে মাঝে কিছু অসন্তোষ আসে ঠিকই, কিন্তু বেশি ক্ষণ থাকে না ।  এক মাত্র ছেলে , কি করে যে এত বুদ্ধিমান হল তাও তিনি জানেন না । ছেলে কিভাবে যেন,  নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালিয়ে নেয় । মাঝে মাঝে বাড়ি আসে , এলেই আগে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে । গর্বে বুকটা ভরে যায় তাঁর। লেখাপড়া কি করে, কোথায় করে কিছুই ঠিক জানেন না তিনি । জেনেই বা কি করবেন , শুধু এটুকুই জানেন তাঁর ছেলে খুব ভালো মানুষ । আর তাঁর কিছুই চাই না।  কিছুদিন পর , ছেলে কিছু টাকা পেতে শুরু করল । পড়ছে বলে নাকি টাকা পায় ।  বাড়ি এলেই হাতে টাকা দিয়ে যায় আর আদুরে গলায় রাগি রাগি ভাব এনে তাঁকে কাজ করতে বারন করে ।  তবে বেশি জোরও করে না । কারন ছেলে বাবাকে ঠিক বোঝে। কিছু মানুষ কাজ করে, বাঁচার জন্য, টাকার জন্য নয় । এই ছোট্ট ব্যাবসার জন্য রাস্তার ধারে বসে কতো মানুষের মুখ দেখেন তিনি, যাদের কেউ তাঁকে লক্ষ্য করে কেও করে না । বছর বছর ধরে জীবনের স্রোত বয়ে যেতে দেখেছেন চোখের সামনে ।  এতো বছরে এসবের মধ্যেই তিনি যে সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন , সেই  অভ্যেস কি সহজে ছাড়া যায় ।


আজ  প্রায় দশ বছরের বেশি হয়ে গেল সেই মানুষটা আর নেই ।  সকালে গরুকে জল দেওয়া , দুপুরে ভাতে ভাত  রান্না , তার পর বাজারে যাওয়া সবই ঠিক ছিল অন্য দিন গুলোর মতোই । রাতে খাওয়ার পর বুকে কেমন এক চাপা বাথ্যা শুরু হল, কিছু ক্ষণের কষ্ট , তাঁর পর সব ঠিক হয়ে গেল । কাউকে কষ্ট দিতেতো তিনি আসেননি , তাই  কষ্ট দেনওনি । নিঃশব্দে হাসি মুখে চলে গেলন । মুখাগ্নির পর ছেলে দুরে বসে , বাবার  চিতার ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টে । সে দেখেছিল চিতার সাদা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে । তার পর কোত্থেকে যেন এক দমকা হাওয়া এসে সেই ধোঁয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল উত্তর আকাশে । শ্মশান যাত্রীদের  কেউ কেউ বলল , চিতার ধোঁয়া উত্তর আকাশে যাচ্ছে , তবে তিনি  স্বর্গেই যাচ্ছেন । স্কুলের  সাইকেল বারান্দায় এখন আর  কাউকে বসতে দেওয়া হয় না । হাটের সেই জায়গা দখল করেছে অন্য এক ব্যাবসাই। আর পূজার প্যান্ডেলের বাম দিকে কোনের জায়গাটা খালি আন্ধকার । আর তিনি আছেন ঐ হাওয়ায় অভিমুখে । 


মৌমিতা সাহু
ব্যাঙ্গালোর , 26/06/2016

Tuesday, 21 June 2016

বাংলা মানে

দেখেছ কি তুমি  ভোরের আকাশে সূর্যের আগমন;
দিয়েছ কি তারে  গোধূলি বেলায় বিদায় সম্ভাষণ  ?

তুমি কি দেখেছ সোনালি ফসলে ভরা বাংলার বুক ;
দেখেছ কি তুমি পলাশ ফুলের, বসন্তে রাঙা মুখ ?

বানের জলে  ভাসতে ফসল কিংবা ভাসতে প্রাণ ;
দেখেছ কি তুমি জলের অভাবে শুকিয়ে যাওয়া ধান ?

ফুল পাতা ভরা  পদ্ম পুকুর ,করেছ কি সেথা স্নান ;
কুড়ালে কি তুমি ভোরের শিউলি,  নিয়েছ কি তার ঘ্রাণ ?

তুমি কি দেখেছ বৈশাখী ঝড়, কুয়াশায় মোড়া ভোর ;
করেছ কি তুমি নদীর কিনারে ভোজনের তোড়জোড় ?

বৃষ্টিতে ভিজে জল কাদা মেখে খেলেছ কি ফুটবল ;
দেখছ কি তুমি মাঠের মাঝে জ্যান্ত মাছের দল  ?

মাঠ ভরা সাদা রজনীগন্ধা, লাল  গোলাপের চাষ ;
মাতালো যে হাওয়া , সেই  না দেখা বকুল ফুলের সুবাস?

চড়েছ কি তুমি পালকি কখনো, দিয়েছ কি রথে টান ;
শুনেছ কি তুমি একতারা হাতে কোন বাউলের  গান ?

তোমদের কাছে ,

বাংলা মানে মিষ্টি দই আর রসগোল্লার হাঁড়ি ।
বাংলা মানে ইলিশ মাছ,  লাল পাড় সাদা শাড়ি ।।
বাংলা মানে ভিক্টোরিয়া,  দুর্গা মায়ের মুখ ।
বাংলা মানে সেই পুরনো শহর দেখার সুখ ।।
বাংলা মানে হাওড়া ব্রিজ  আর গঙ্গার বুকে নৌকা ।


বাংলা মানে তোমরা বোঝো শুধুই কোলকাতা ।।



মৌমিতা সাহু , ব্যাঙ্গালোর
২২-০৬-২০১৬