মা বলে আমার যখন এক বছর নয় মাস বয়স তখন আমরা দেশের বাড়ি
ছেড়ে বাবার চাকরির জায়গায় চলে এসেছিলাম । আর তখন থেকেই আমার পৃথিবী মানে আমি আমার
মা আর বাবা । তার কিছুকাল পর সেই পৃথিবীতে আর এক সদস্য যোগ দিয়েছিল, আমার ভাই ।
পারিবার বলতে যা বোঝায় তা মোটামুটি এর মধ্যেই সীমিত । রক্তের সম্পর্কের মানুষই যে
আপন, না হলে পর তা বিশ্বাস করার শিক্ষা আমি ছোট থেকে পাইনি । তবে আপনজন আর পরিবার
দুটো জিনিস কি এক? পরিবারের এমন মানুসজন থাকে যারা কোনদিনই আপনজন হয়ে উঠতে পারে না
। আবার পরিবারের মানুষ না হয়েও অনেকেই আপনজন হয়ে যায় আনায়াসে । এই পরিবার আর আপনজন
নিয়ে লিখলে হয়তো একটা গোটা বই লেখা যায় , যদিও আমার এখনও সেই যোগ্যতা হয়নি, তাও
বুঝতে ঠিকই পারি । মানুষ যেমন পরিবারের জন্য আপনজনকে দুরে সরিয়ে দিতে পারে , তেমনি
আপনজনের জন্য পরিবারেরও রক্ত ঝরাতে পারে । আমার বাবা , মায়ের অনেক ভাই বোন , তাদেরও
অনেক ছেলে মেয়ে। সেদিক থেকে আমার পরিবার বেশ বড়সড় । কিন্তু তা
সত্যেও, আমি কখনো এতো বড় পরিবারের আপনজন হতে পারিনি । মনে হয়, বিশাল কোন বড় পুরনো
গাছের তিন পাতার একটা ছোট্ট একটা ডাল কোন এক বিষম ঝড়ে ভেঙ্গে অনেক দুরে গিয়ে পড়েছে
। আর সেই ডাল থেকে আবার নতুন গাছের জন্ম হয়েছে । এখন সেই গাছের চারটা পাতা, কিন্তু
একটাই প্রান । এমনি হাজার ছোট বড় গুল্ম, লতা, বৃক্ষের মাঝে আমাদের ছোট্ট নতুন প্রানকে
সজীব সতেজ সুন্দর ও স্বাস্থবান রাখার প্রচেষ্টা চলছে ।
আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক যৌথ পরিবারের বাস ছিল, এখনও আছে
। তাতে কতো ভাই বোনেরা বড়ো হয়ে উঠেছে একসাথে । তাদের দেখে আমার মনে হতো, আমরাও যদি
একসাথে থাকতাম কতো ভালো হত । বড় হতে হতে আরও বুঝলাম এই সব পরিবার আর সব পরিবারের মতোই ।
একসাথে থেকেও এরা কেউ কারো আপনজন হয়ে উঠতে পারেনি । ধিরে ধিরে আমার বিশ্বাস হতে
শুরু করেছিল , এই পৃথিবীতে এমন কোন একান্নবর্তী পরিবার নেই, যারা শুধু একই অন্নেই
নয় প্রকৃত অর্থেই একত্রে সুখে বসবাস করছে । এই বিশ্বাস আমাকে এই অভাব বোধ থেকে
খানিক মুক্তি দিয়েছিল । মনে হত, এত বড় পরিবারের সাথে থাকলে হয়তো এত স্বাধীনতা
পেতাম না, এই বেশ ভাল । পরিবার পুরো না থাকলেই বা , আপনজনেরতো আভাব নেই । এই
আপনজনেরাই পারিবার । শুধু দ্বিধা বোধ করি যখন কেউ পরিবারের ব্যাপারে প্রশ্ন করে ।
বাবার কজন ভাই বোন , কি করে, কোথায় থাকে , এই পর্যন্ত তাও ঠিক থাকে । কিন্তু
সমস্যা হয় পরের প্রশ্নে, কাকা, পিসি এদের ছেলে মেয়ে কতো জন, তারা কতো বড়ো, তাদের
নাম কি ? মুশকিলে পরে যাই আমি । ছেলে মেয়ে কতো জন জানি , তবে তাদের নাম আর কে কোন
ক্লাসে পরে, এতো সব আমি জানি না । এমন তুতো ভাইও আছে যাকে আমি কখনো চোখেই দেখিনি ।
সে যাই হোক, কোন ভাবে এই সব অস্বস্থিকর প্রশ্নের ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে রক্ষা
পাওয়ার চেষ্টা করি । তখন মনে হয়, আমার পারিবারের লোক জন আপনজন না হোক, পারিবার
হিসেবে থাকলেও ঠিক ছিল । পরিবারের লোকজন এখন শুধুই দুঃসম্পর্কের মানুষ । যারা কিছু
সামাজিকতা , নিয়ম কানুন আর দায়ব্ধতার জন্যই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অনুভব করে ।
যারা না আপনজন, না পরিবার , শুধুই অপ্রয়োজনীয় তিক্ত রক্ত সম্পর্ক । পরিবারের সাথে
সম্পর্ক ত্যাগের জন্য নেহাত কোন যথাযথ বিচ্ছেদ আইন নেই । তা নাহলে এই সামাজিক
প্রয়োজনীয়তা টুকুও পড়ত না । তবে পরিবার আর আপনজন নিয়ে ভিন্ন মনোভাব থাকলেও, আমি
একদিন এমন এক পরিবারের সাথে খুব স্বল্প সময়ের জন্য সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম,
যার পর আমার চিন্তা ভাবনার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।
যদিও আমি এখন একজন কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার , তবে এটা
পূর্বপরিকল্পিত মোটেই না । সময়ের সাথে সুযোগ আর বাবা, মা, শিক্ষক ও বন্ধুদের
সাহায্য মিলিয়ে আজকের এই পরিচয়ের জন্ম । লোকজন সাধারণত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর
নিজের পছন্দ মতো বা পরিবারের উপদেশ মতো ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারির জন্য প্রস্তুতি
নেয়, কোচিং নেয় । আমার ছোট থেকে বরাবরই অঙ্ক ভীষণ ভালো লাগে । অঙ্ক , ধাঁধা এই সব
সমাধান করতে আমার বড়ো ভাললাগে । ছোট থেকে অঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে পড়ার কথা
ভাবিনি । তাই যেখানে যা অঙ্কের পরীক্ষা হত , তাই দিতাম । ফল সব সময় ভালো হত তা নয়,
তবে তাতে আমার উৎসাহ কম হত না । এই উৎসাহ এখনও থাকলেও , ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ এ
বুঝেছিলাম, ভালোলাগা কেই ভবিষ্যৎ বানানো ঠিক হবে না । ভবিষ্যতের জন্য এমন কিছু চাই,
যা আমার ভালোও লাগে আর সামলানোও যায় । বেশি ভাবতে হল না,
দ্বিতীয় যা ভালো লাগে তা হল, বায়োলজি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে মোটামুটি খুশিতেই
আছি । যদিও বাবার উপদেশে ডাক্তারির জন্য পরীক্ষা দেব বলে ফর্ম ভরেছি, তবে, আমি
প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি বায়োলজি নিয়েই পড়ব । তাই পরীক্ষার প্রস্তুতি
নিচ্ছিলাম নিজে নিজেই ।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন এসে গেল । পরীক্ষার সিট পড়েছে
বাড়ি থেকে প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে । পরীক্ষার আগের দিন দুপুরের খাওয়া
তাড়াতাড়ি সেরে বাবার সাথে বেরিয়ে পড়লাম । সাথে রাতের পোশাক, গামছা, ছিরুনি, ব্রাশ,
কোলগেট আর তিনটি পাতলা পাতলা প্রশ্ন উত্তরের বই, পেন, পেনসিল আর পরীক্ষার অ্যাডমিট
কার্ড । বাবা আমাকে নিয়ে গন্তব্যস্থলে যখন পৌঁছলেন তখন বেলা তিনটের বেশি । বাস
থেকে নেমে, এদিক ওদিক দেখে একটা দোকানের সামনের ব্রেঞ্চে আমাকে বসিয়ে জিনিসপত্র
রেখে বাবা বেরোলেন রাত কাটানোর জায়গার ব্যাবস্থা করতে । দুরে কিছু ছোট খাটো
হোটেলের নাম দেখা যাচ্ছে । বসে রইলাম, বাবা ফেরার অপেক্ষায় । প্রায় মিনিট
চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ পর বাবা ফিরে এলেন । ঘামে ভিজে গেছেন, মুখটা বিকেলের রোদে পুড়ে
আরও কালো দেখাচ্ছে । বাবা হতাশ হয়ে জানালেন, কোন হটেলেই একটাও ঘর খালি নেই । তাহলে
কি হবে এখন? বাবাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল । মনে হল বলি ‘ফিরে চলো বাবা’ । কিন্তু
সাহস হচ্ছিল না । কি করি কি করি এমনি ভাবছেন , এমন সময় রাস্তার ওপারের একটা সাইকেল
দোকানের দিকে বাবার নজর গেল । বাবা বেশ খুশি হয়ে , বললেন, ‘আয় আমার সাথে’ । দোকানে
এক ভদ্র লোক একটা সাইকেল মেরামত করছিলেন । বাবা কে দেখে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন । দুজনের
এতো খুশি দেখে বুঝলাম, অনেক দিন পর দুই আপনজনের দেখা হয়েছে । ভদ্র লোক বাবাকে চা ও
আমাকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । বাবা বললেন, ‘সে সব হবে পরে । আমার একটা
উপকার করতে পার ?’ ভদ্র লোক বললেন ‘বলুন না, কি করতে পারি ।’ বাবা বললেন ‘মেয়ের
পরীক্ষা । তাই এখানে এসেছি । কিন্তু কোন হটেলেই জায়গা নেই । এখানে যদি কোথাও থাকার
ব্যাবস্থা হয় । একরাতের জন্য ! যা টাকা হয় দেব । মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়ে
গেছি ।’ ভদ্র লোক বললেন ‘আপনি এখানেই বসুন । আমি দশ মিনিটে ঘুরে আসছি।’ এই বলেই
তিনি চলে গেলেন । ফিরে এলেন আর একজন ভদ্র লোককে নিয়ে । তাঁদের বাড়িতেই সে রাতের
জন্য আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করেছেন । বললেন, “এদের অনেক ভাই, সবাই একসাথে থাকে ।
বাড়িতে অনেক লোকজন, আমার বয়সী মেয়েরাও আছে । তাই ভয়ের কিছু নেই ।” ভদ্র লোক এত
কিছু ভেবেছেন ভেবে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা থাকলো না ।
বাজার থেকে ভদ্র লোকের বাড়ি যাওয়ার জন্য যখন যাত্রা শুরু
করলাম তখন সূর্য অস্ত যায় যায় । পশ্চিম আকাশ সিঁদুরে সেজে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে
তৈরি । সেই রাঙা আকাশকে সামনে রেখে এগোচ্ছিলাম । এরকম রাস্তায় যাওয়ার সে ছিল এক
নতুন অভিজ্ঞতা । এবার দেখলাম, নদীর বাঁধের মতো অনেক উঁচু দিয়ে রাস্তা । তার দুই
দিকে লাল টালির ছাওয়া বাড়ি । অনেক নিচুতে বাড়ি গুলি । ওপর থেকে বাড়ির দেওয়াল দেখা
যায় না । ঘন গাছপালায় ঘেরা বাড়ি গুলোর লাল টালির চাল (ছাদের চলতি বাংলা) ঠিক যেন
বড় বড় কোন লাল জংলী ফুল । প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমরা আমাদের গন্তব্যে
পৌঁছলাম । যে বাড়িতে আমরা থাকব, সেটি পাকার, বাকি গুলো সব মাটির, টালির ছাদ,
রাস্তায় দেখা বাড়ি গুলোর মতো । বাড়ির ভেতরে এসে দেখি এক মাঝারি উচ্চতার বছর
চল্লিশের একজন মহিলা সাথে বছর একুশ বাইশের একটি মেয়ে, আসুন আসুন করে আমাদের আপ্যায়ন
করে ভেতরে নিয়ে গেলেন । মুখের গড়ন, চেহারায় মিল দেখে বোঝা যায় এঁরা মা মেয়ে ।
প্রথম মনে হল কি করে জানলেন, আমরা আসছি। পরে মনে হল, টেলিফোন করে দিয়েছিলেন হবে ।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও দেখে অবাক হলাম এই যে , আরও তিন চারটি বড় ছোট মেয়ে হাজির
হয়েছে আমাদের আশেপাশে । আমাকে দেখে বলল “তুমি আমাদের সাথে যাবে?” । আমি কি বলব ভেবে
পেলাম না । ভদ্র মহিলা, তাদের ধমক দিয়ে বললেন , “এই এসেছে , স্নান করে
কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে দে। তোরা যা এখন ।” তাদের মধ্যে একটা বছর বার তেরর
মেয়ে আমার হাত ধরে বলল, “আমি একটু পর এসে তোমাকে নিয়ে যাব ।” দরজার বাইরে একটা
দুরের ঘর দেখিয়ে বলল “ওই ঘরটায় । তুমি যাবে তো? সবাই তোমার সাথে পরিচয় করবে বলে
আপেক্ষা করছে” । আমি কিছু বলার আগেই সে দৌড়ে পালাল । ছাদের একটা সুন্দর ঘরে
আমাদের থাকতে দেওয়া হল । প্রথমেই স্নান সেরে নিলাম । কিছু খেয়ে বাবা কে জিজ্ঞেস
করলাম, একটু ঘুরে আসব কি না । বাবা বললেন, “যা ঘুরে আয় , আমি একটু বিশ্রাম করি । রাতের
খাওয়ার সময় ডাকিস ।” নিচে নেমে এসে দেখি , সেই ছোট্ট মেয়েটা এসে গেছে । আমি বাড়ির
ভদ্র মহিলাকে বললাম “কাকিমা আমি একটু ঘুরে আসি ?” উনি রান্না চাপাতে চাপাতে বললেন
, ‘এসো’। আর ছোট্ট মেয়েটাকে বললেন ‘বেশিক্ষণ আটকে রাখবি না । কাল পরীক্ষা আছে । আজ
তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমবে ।’ মনে হল আমার মা যেন ওনাকে সব শিখিয়ে দিয়েছেন । বাড়ির বাইরে
বেরিয়ে দেখি চারিদিক নিঃঝুম । কেউ কোথাও নেই । সব বাড়ির বাইরে একটা করে বাল্ব
জ্বলছে । একটা বাড়ির বারান্দা পেরিয়ে , আর একটা বারান্দা দিয়ে অন্য একটা ঘরে
পৌঁছলাম । আয়তাকার ঘরের একদম শেষে একটা খাট , অন্য চার পাশে নানা আসবাবে ভরা । টেবিল,
চেয়ার , আলমারি ছাড়া হারমনিয়ামও ছিল একপাশে । সেই ঘরে একে একে সবাই এল । ছোট বড়ো এক
গুচ্ছ মেয়ের দল । তার পর আমার একটা ছোটোখাটো ইন্টার্ভিউ হল । কোথায়
বাড়ি, কেন এসেছি , পরীক্ষার জন্য পুরোপুরি তৈরি কিনা , ভয় করছে কিনা । গান নাচ
জানি কি না । কি খেতে ভালো লাগে । কি খেতে ভালো লাগে না । সিনেমা দেখি কি না । কার
কোন সিনেমা । আর ও হাজারো প্রশ্ন । সঙ্গে সঙ্গে তাদের কার কি পছন্দ অপছন্দ তাও বলল
। তাদের মধ্যে একজন বলল , “আমরা সব বোনেরা বেশিরভাগ সময় এই ঘরটাতেই থাকে” । এদের মধ্যে
সব চেয়ে যে বড়ো , তার নাম ‘মৌমিতা’ । ইংরেজিতে এম এ করছে । অন্যদের নাম মনে নেই ।
মনে হল, দুজন মৌমিতার জীবন একদম দুরকম । দুজনের বাড়ির পরিবেশ , বড় হয়ে ওঠা সব
আলাদা, শুধু নামটাই এক । আমরা বাড়ি চলে আসার পরও আমাদের বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল এই
মৌমিতাদি । আমাদের মধ্যে কেমন একটা সুক্ষ্ম টান তৈরি হয়েছিল, যা পরে কখন যে ছিঁড়ে
গেছে টেরই পাইনি । সেদিন অনেক গল্প , হাসি ঠাট্টার পর খাওয়ার ডাক পড়তে ফিরে এলাম ।
এক সন্ধ্যায় আমি ওদেরই একজন হয়ে গেছিলাম । ওরা সবাই আমাকে
পৌঁছে দিয়ে গেল ঘরে। কেউ কেউ মন খারাপ করল , তাদের বাড়ি যাওয়া হল না বলে । ফিরে
এসে বাবাকে ঘুম থেকে তুললাম । ডাল , ভাত , ডিম ভাজা , আলু ভাজা , সবজি দিয়ে রাতের
খাওয়ার হল । মনেই হল না, বাইরে কোথাও খাচ্ছি । রাতে খুব ভালো ঘুম হল । সকাল সকাল
উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে গেলাম । ভাবলাম, এমনি বেরিয়ে যাব , কিন্তু কাকিমা ছাড়লেন
না । বললেন ‘সারাদিনের পরীক্ষা, একটু গরম ভাত খেয়ে যাও’ । ভাত, ডাল,
মাছের ঝাল খাওয়া হল । সেই মাছের ঝালের স্বাদ ঠিক মায়ের রান্না মাছের ঝালের মতো ছিল
। বেরোনোর আগে আবার সবাই হাজির , সবার সে কী মন খারাপ । পরীক্ষা শেষে আমরা যেন
আবার ফিরে আসি । অন্তত আর একটা দিন থেকে যাই । যদি, আজ ফিরে নাও আসি তবে যেন কথা
দিই, আবার আসব । যোগাযোগ রাখব । যাদের বাড়িতে ছিলাম তাদের মেয়ে কলেজে থার্ড ইয়ারের
ছাত্রি । আমরা স্বজাতি শুনে কাকিমা মেয়ের জন্য ভাল পাত্র দেখার জন্য বাবাকে অনুরোধ
জানালেন । শেষে হাসি মুখে সবাইকে বিদায় জানিয়ে পরীক্ষা সেন্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে
পড়েছিলাম ।
পরীক্ষা দিয়েছিলাম , ফল যে ভাল হয়নি সে তো সবাই বুঝতেই
পারছেন । ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি । ইঞ্জিনিয়ার হয়ে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত
থাকি । আমাদের জীবনে সব কিছু পুর্বনির্ধারিত বা পুর্বপরিকল্পিত হয় না । আর স্থায়ীও
হয় না । পছন্দ অপছন্দ, চিন্তা ভাবনা পাল্টায় । সিদ্ধান্ত পাল্টায় । মানসিকতা
পাল্টায় । সমস্যা পাল্টায় । সমাধানের পথ পাল্টায় । জীবনের পথে এই আবিরাম পরিবর্তন
আমাদের উপহার দেয় ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা । সে অভিজ্ঞতা কখন মধুর ,কখনও
তিক্ত । সেই রাতে আমি পেয়েছিলাম একটা একান্নবর্তী পরিবার আর অনেক আপনজন, যারা একই
অন্নে লালিত পালিত হয় না ঠিকই, একই ছাদের তলায় ও থাকে না ,
তবু তারা এক । আবার একই সাথে অন্য আর পাঁচটা পরিবারের থেকে কিছু আলাদা । আমি অন্তত
সেই একটা রাতের জন্য সেই পরিবারের সদস্যের সাথে সাথে তাদের আপনজন হতে পেরেছিলাম । এই
উপলব্ধি আমাকে আজও বার বার সুখি করে । আর এই ভেবে আস্বস্থ করে যে , একান্নবর্তী না
হলেও অন্তত একে অন্যের পাশে বর্তমানেও থাকা যায়।
Moumita Sahu
16/03/2016
No comments:
Post a Comment