Tuesday, 26 January 2016

সপ্ন

বন্ধ দারের আগল ভেঙ্গে, সপ্ন আসে মনে
অলস শরীর ঘুমিয়ে থাকে, মিঠা সপ্ন ভ্রমে ।।
ভাঙা দরজার দোরে বসে সপ্ন অপেক্ষায়
এবার বুঝি জাগবে শরীর, করবে তারে জয় ।।
অঘোর ঘুমে শরীর মশাই, পাশ ফিরে না চায়
সপ্ন শেষে ক্লান্ত হয়ে অন্য মনে যায় ।।
অলস শরীর উঠল শেষে দিবানিদ্রার পরে
বিশাল একটা হাই তুলে সে, ভাবল ঘুমের ঘোরে ।।
‘সপ্নটা আজ খাসা ছিল, ছিল নরম গদি’ !
‘সপ্নে ছিলাম রাজার রাজা, সত্যি হত যদি ’ !!

     মৌমিতা সাহু

/০১/২০১৬, ব্যাঙ্গালোর 

Monday, 25 January 2016

সন্তান


ন্যাশানাল হাইওয়ে সিক্স , কলকাতা থেকে মুম্বাই যাওয়ার জাতীয় সড়ক । সবাই সাধারণত বোম্বাই রোডই বলে এটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দুর দিয়ে গিয়েছেএই চল্লিশ কিমি এসে বোম্বাই রোড ধরে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে হয় আরও কুড়ি কিলোমিটার জায়গাটার নাম বসন্তপুর । কেউ বলে, অকড়া বসন্তপুরআবার কেউ কেউ শুধুই অকড়া বলে । এই বাস স্ট্যান্ড এর সব চেয়ে কাছের গ্রামের নাম সুলতানপুর । তাই বাসে, সুলতানপুর বললেও চলে । সুলতানপুর যেতে হলে, বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হতে হয় । সুলতানপুরের চৌধুরিদের বাড়ি বললে যে কোন রিক্সা ওয়ালা নিয়ে যাবে । ধান চাষের জমি, গাছগাছালি ঘেরা ছোট বড় মাটির , ইটের বাড়ি পেরিয়ে, বড় শ্মশান আর শিব মন্দির এসে পড়লেই বুঝবে, পৌঁছে গেছি ।   

এই চৌধুরীদের বাড়িতে চার ভাই এর বাস বাড়ির সবাই খুব ভদ্র, নম্র ও শান্ত স্বভাবেরচার ভাই তাদের নিজের নিজের পরিবারের সাথে ছাদের তলায় আলাদা আলাদা সংসার করে । তবে সেটা খাওয়ার সময় ছাড়া খুব একটা বোঝার উপায় নেই । কারন তাদের রান্না ঘর টুকুই শুধু আলাদা, মন গুলো সব এক এক টুকরো মাছও কিভাবে তিনজনকে ভাগ করে, হাসি মুখে সম্মানের সাথে খেতে দিতে হয় তা এই পরিবারের গৃহিণীরা খুব ভালো ভাবেই জানত । শুনেছি আমার বাবা এবং এক কাকা এক সময় এদের বাড়িতে থেকে বাচ্চাদের টিউশান পড়াতেন । তাই এদের বাড়ির সবাই বাবাকে ‘মাস্টারমসয়’ বলে ডাকত সে আমার জন্মের অনেক আগের কথা । তবে সেই থেকেই আমাদের পরিবার আর এই চৌধুরী পরিবারের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আমার জন্মের পর থেকে মা বাবার সাথে আমারও যাতায়াত শুরু হয় এই বাড়িতে

বড় ভাই শ্রী মদন চৌধুরী। বসন্তপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে বোম্বাই রোড পেরিয়ে গলির মোরাম রাস্তা ধরে একটু এগোলেই তার সাথে দেখা হবে । সেখানেই রাস্তার ধারে একটা পানের দোকান আছে তার । স্ত্রী লতিকার, ঘরের কাজ থেকে মুহূর্তের বিরাম নেই। দুই ছেলে দেবাশিস আর প্রেমাশিস । দেবাশিস বড়, প্রেমাশিস ছোট । আর এক মেয়ে শিখা । এছাড়া মেজ ভাই এক ছেলে আশিস আর তার স্ত্রীর সাথে থাকেসেজ ভাই এর দুই ছেলে । লেলু আর ফেলু । কেউ কেউ লালা ফেলা বলেও ডাকত । এই লেলু আর ফেলু আমার চেয়ে কয়েক বছরেরই বড় ছিল । তাই ওখানে গেলে সারক্ষণ ওদের সাথে ঘুরে বেড়ানোই আমার একমাত্র কাজ ছিল । প্রেমাশিস দাদা, লেলু আর ফেলু আমাকে বনু বলে ডাকত । এতো মিষ্টি করে আর কেউ কখনো আমাকে বনু বলে ডাকেনি । আর একটা ব্যাপার হল এদের বড় ভাই আর সেজ ভাই দুই আপন বোনকে বিয়ে করে । লতিকা আর মলিনা । তাই এই দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক আরও বেশি ভালো ছিল । ছোট ভাইয়ের তিনটি মেয়ে । তার মধ্যে বড় আর মেজও আমার খেলার সাথি ছিল ।

আমরা মুলত বড়র মানে মদন জেঠুর বাড়িরই অতিথি ছিলাম । আমরা গেলে মলিনা মাসিদের আর লতিকা জেঠিমাদের রান্না একসাথে হত । সকালে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই লেলু আর ফেলুর লেখাপড়া শেষ হয়ে যেততার পর তাদের সাথে পাড়ার এদিক সেদিক ঘোরা, নদী পাড়ে ধুরতে যাওয়া, কাঁচা টক কুল, কাঁচা পেয়ারা পাড়া এই সব করে দুপুর হয়ে যেত । দেবাশিস দাদা ছাড়া লেলু ফেলু যমকেও ভয় পেত না । তাই দেবাশিস দাদা বলার আগেই স্নান আর দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেলতে হত । খাওয়ার পর ঘুমনোর অনেক চেষ্টা করেও যখন ঘুম আসতো না তখন সকলে লুডো বা সাপ সিঁড়ি খেলতে বসতাম । কোন কোন দিন বিকেলে মায়ের সাথে কংসাবতীর বেড়াতে চরে যেতাম। সেখানে নদীর ওপারের সবাই আসতো আমার আর মায়ের সাথে দেখা করতে । সাথে পিঠে, দুধ, নারকেল, নারকেল নাড়ু, তাল শাঁস নিয়ে আসত । নদীর ওপারে আমাদের দেশের বাড়ি, ধর্মপুরেসেখানে আমাদের যাওয়া মানা ছিল, বড়দের কোন এক বোকা বোকা মান আভিমানের কারনে। মা বলে আমি যখন এক বছর নয় মাসের তখন আমাকে নিয়ে বাবার কাছে চলে আসে বাবার কাজের জায়গায় । তার পর থেকে আমি আর মা সেখানকার পাড়ার জেঠিমা কাকিমা , দাদা দিদিদের সাথে নদীর চরেই দেখা করতাম । সারা বিকেল নদীর বালি ঘেঁটে ঘেঁটে, সন্ধ্যার সময় আবার ফিরে আসতাম মদন জেঠুদের বাড়িতে । সারা দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত সবাই । আমরা ছোটরা একটা ঘরে মলিনা মাসির সাথে ঘুমোতাম । দু তিনটা মাদুর একসাথে পেতে লাইন দিয়ে বালিশ দেওয়া হত । সকালে উঠে দেখতাম আমি বিছানায় একা, বাকি সবার ঘণ্টা তিনেক আগেই সকাল হয়েছে ।

সালটা ১৯৯৫ কি ১৯৯৬ । বোম্বাই রোড তখনও ওয়ান ওয়ে হয়নি । বোম্বাই রোড ওয়ান ওয়ে হওয়া শুরু হয়েছিলো ১৯৯৮ এর পর, বাইজপেই এর সময় । একটাই রাস্তায় বড় বড় মাল বোঝাই লরি, বাস , ট্যাক্সি, মারুতি, মোটর সাইকেল সব ছুটছে । রাস্তার বাম দিক ধরে গাড়ি গুলো দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে আর ডান দিক দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে । সেসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পেরতে হতো । আমাদের বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে একটা কলেজ আছে । প্রেমাশিসদা সেই কলেজে ভর্তি হয়েছিলো । সে রোজ বাড়ি থেকে এতো দূরে কলেজ করতে আসতো । সকাল থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যে বেলায় ফেরা । তাই, এই রাস্তা পেরিয়ে বাসে চড়া, বা বাস থেকে নেমে রাস্তা পেরনো তার রোজকার জীবন যাপনের অংশ ছিল। মাঝে মাঝেই শনিবার ক্লাস শেষে আমাদের বাড়িতে থেকে যেত । একেবারে সোমবার ক্লাস করে বাড়ি ফিরত । সেরকমই এক শনিবার, সকাল ১০ টার কাছাকাছি, রান্না ঘরে মা রান্নায় খুবই ব্যাস্ত । আমি মায়ের কাছেই কিছু একটা করছিলাম । বাবা বাথরুমে স্নানে গেছেন । রোজকার মতো বাবা স্নান সেরে বেরলেই মা খেতে দেবে । আর আমি বাবার সাথে এক থালায় খেয়ে, বাবার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাব । হঠাৎ বাবার স্কুলের একজন অশিক্ষণ কর্মী মানে সহজ ইংরেজিতে যাকে বলে নন-টিচিং স্টাফ সাইকেল নিয়ে হাজির। সবাই তাকে হাওড়া বলেই ডাকে, ভালো নাম তপন । তখন হাতে হাতে মোবাইলতো দুরের কথা, বাড়িতে বাড়িতে ল্যান্ড লাইনও ছিল না । আমাদেরও ছিল না । আমাদের ল্যান্ড লাইন হোল, ১৯৯৮ এর শেষের দিকে বা ১৯৯৯ এর শুরুতে । সে যাই হোক , তাই আমাদের যে কোন ফোন আসত, হয় বাবার স্কুলে, নয়তো আমাদের পাশের বাড়িতে । তা সেদিন ফোনটা এসেছিল স্কুলের ফোনে । স্কুল যাওয়ার ঠিক আগে স্কুলের কারো বাড়িতে আশা দেখেই মা বুঝেছিল কিছু জরুরি ব্যাপারেই এসেছে । মা জিজ্ঞেস করায়, তিনি বললেন, বসন্তপুর থেকে ফোন এসেছিল । প্রেমাশিস নামে কারো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মারা গেছে। বাবা পড়িমরি করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভালো করে জিজ্ঞেস করে বুঝলেন, নাম বা জায়গা কোনটাই শুনতে সে ভুল করেননি । সঙ্গে সঙ্গে বাবা মা আর ছোট্ট ভাই এর সাথে পৌঁছলাম সেখানে ।

 সেদিনের ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে । কেউ দাওয়ায় মাটিতে বসে, কেউ বারান্দার সিমেন্টের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে । কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, কেউ বা ফিস ফিস করে কথা বলছে আবার কেউবা বোবার মতো চুপ করে আছে । টুকিটাকি কথাবার্তায় জানা গেল, সেদিনও সে অন্যান্য দিনের মতো সকালে স্নান সেরে খেয়ে বেরিয়েছিল কলেজ যাবে বলে । আর বলেছিল, কলেজ শেষে আমাদের বাড়িতেই থাকবে । ফিরবে সোমবার ।

ওদের ঘরে ঢুকলেই বাম দিকে ছোট্ট একটা বৈঠকখানা, তার পর একটা ঘর , আর সামনে টানা বারান্দা শেষ হয়েছে রান্না ঘরের দরজায় । টানা বারান্দার কোন বড় জানালা ছিল না । তাই ভেতরটা দিনের বেলাও বেশ অন্ধকার লাগত । বারান্দার ডান দিকে, ওপরে, সব সময় একটা বাঁশ বাঁধা থাকতসেটাতে বাড়ির সকলের নিত্য পরা জামা কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হত ।  সেদিন গিয়ে আমি ঘরের এদিক ওদিক ঘুরছিলাম । জেঠিমা পাগলের মতো কাঁদছে । মলিনা মাসির কেঁদে কেঁদে চোখ লাল । কাপড়টা মুখে চেপে ধরে ফিস ফিস করে একে ওকে সকালে প্রেমাশিসদা কি কি করেছিল, কি কি বলেছিল, সেই সব বার বার বলছে, আর চোখ মুছছে । ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই বাঁশটার দিকে চোখ পড়ল আমার, দেখি সেখানে প্রেমাশিসদার ঘন নীল রঙের ওপর খুব পাতলা সাদা চেকের জামাটা তখনও ঝুলছেশেষবার সে, সেটা পরেই এসেছিল আমাদের বাড়ি । রোগা , ৫’৩’’ হাইট হবে খুব জোর । ধারালো মুখটা মনে পড়ল সেই নীল জামা পরেই শেষ বার দেখেছিলাম তাকে । বিশ্বাস হচ্ছিল না, সবাই তার মর দেহ আশার আপেক্ষা করছিল তাকে যখন আনা হল তখন বেলা পাঁচটা মতো । ততক্ষণে কি করে কি হয়েছিল সে সবও জানা হয়ে গিয়েছিল ।

 ভাত খেয়ে সাইকেল নিয়ে সে তাড়াতাড়ি পৌঁছায় বসন্তপুর বাস স্ট্যান্ডে । পেনের কালি শেষ হয়ে গেছিল। বাস আসতে মিনিট ৫ দেরি দেখে, রাস্তার ওপারে একটা দোকান থেকে পেনটা রিফিল করাতে যায় সে । সেখান থেকেই খেয়াল করে , বাস চলে এসেছে । বাস ছেড়ে যাবে এই চিন্তায় , গাড়ি না দেখেই রাস্তা পার হচ্ছিল সে । প্রায় রাস্তা পেরনোর মুখে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাওয়া এক বিশাল মাল বাহি ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারে তাকে । অনেকটা দূরে লাল ছোট ছোট কঠিন বোলডারের ওপর ছিটকে পড়ে তার শরীরটাডান গালে একটা পাথরের টুকরো ধুকে যায় । আশেপাশের লোকজন সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে তাকে ভ্যান রিকশার তোলে । সামনে ৫০০ মিটারের মধ্যে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পথে একবার বমি করে সে । সকালের সব খাওয়ার বেরিয়ে যায় । আর তার পর সব শেষ । ইন্টারনাল হেমারেজ । মৃত দেহ আনার পর দেখলাম ডান গালে একটা গর্ত । আর পুরো শরীরে তেমন আধাতের দাগ নেই । ময়না করার জন্য, পুরো কপাল আর বুকটা কাটা হয়েছে , আবার সেলাই করে দেওয়া হয়েছে । জেঠিমাকে ছেলের মৃত দেহ থেকে সরানো যাচ্ছিল না । কোন ক্রমে তাকে সরিয়ে , দেহ নিয়ে সকলে চলে গেল শ্মশানে

এর পর আমি যতবার শ্মশানের পাশের রাস্তা দিয়ে জেঠুদের বাড়ি গিয়েছি ততবারই সেখানকার পড়ে থাকা কালো কালো পোড়া কাঠ , বাঁশ , পোড়া কাপড় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, ঠিক কোনখানটায় প্রেমাশিসদাকে পোড়ানো হয়েছিল । মাও জানতো না । নাহলে মা ঠিকই দেখাত । আমার জানার প্রবল ইচ্ছে হত কারন , জেঠিমা তার ছোট ছেলের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি । প্রায় পাগল হয়ে গেছিলমাঝে মাঝেই শ্মশানে চলে আসত আর ছেলের চিতার চাই ভস্ম গায়ে মাখতকেঁদে কেঁদে না খেয়ে না ঘুমিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়তশরীর কঙ্কাল সার হয়ে পড়েছিল । 

এই ঘটনার প্রায় ৭ বছর পর শিখাদির বিয়ে ঠিক হয়। অনেক দিন পর সেখানে গিয়ে আবার কিছুটা খুশির মুহূর্ত কাটাই । জেঠিমা ততদিনে নিজেকে কিছুটা সামলেছেতবে ভুল করেও তার সামনে কেউ প্রেমাশিসদার নাম উচ্চারন করতো না । সেই বিয়েতে আমি প্রথম আমি আমার মেজ কাকু, সান কাকিমা , আর এক খুড়তুতো ভাইকে দেখি । মেজ কাকুকে দেখতে প্রায় বাবার মতো । হাইট একটু কম হবে । মা দুর থেকে কাকুর একটা ফটো তুলেছিল। শিখাদির বিয়ের অনেক ছবি এখনও আমাদের অ্যালবামে আছে । তার মধ্যে মা আর দুই কাকিমার একসাথে বসে খাওয়ারও একটা ছবি আছে । তিনজন একসাথে হাসি মুখে টেবিলে খেতে বসেছে এরকমই একটা ছবি । তিন জা এর একসাথে কাটানো মুহূর্ত একটা ফ্রেমেই বন্দি হয়ে আছে । এই সব, কিছু ছোট ছোট জিনিস সেদিন পেয়েছিলাম । তার পর গেছিলাম আবার প্রায় ২ বছর পর ২০০৩ এর শুরুতে বোধ হয় । দেবাশিসদার বিয়েতে । মাসটা জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারি । বেশ শীত ছিল । বিয়ে করাতে গিয়েছিলাম । সোয়েটার পরলে, সুন্দর জামা দেখাই যাবে না, তাই ঐ কনকনে শীতের রাতেও সোয়েটার পরিনি । নাচা গানা হই হুল্লোড় সবের মাঝে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছিল , জেঠিমা । যেন সে থেকেও নেই । কোন কিছুই তাকে ছুঁতে পারছিল না ।

এর পর থেকে সেভাবে আর যাওয়া হয়নি সুলতানপুর । যোগাযোগ খবরা খবর কমে আসছিল । একদিন শুনলাম শিখাদি, শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে । প্রায় চার বছর সংসার করার বৃথা চেষ্টা করে , অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে , নিঃসন্তান শিখাদি ফিরে এসেছিল তার মায়ের কাছে । বাড়িতে তখন মা, মেয়ে আর বৌমা । অন্য পাঁচটা বাড়ির মতো এবাড়িতেও অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল ধিরে ধিরে । শিখাদি মানসিক ভাবে সুস্থ ছিল না । যদিও আমি কোন দিন তার মধ্যে কোন অস্বভাবিকাতা লক্ষ্য করিনি । সুস্থ মানুষের মতো ,তার স্নান, খাওয়া, ঘুম, কথা বলা ছিল । আমাকে কোলে বসিয়ে ছোট বেলায় গল্প শোনাত । সেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে নিয়েই সমস্যা শুরু হয় । আর একদিন সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয় । শুনেছি হাসপাতালে আর নিয়ে যাওয়া হয়নি তাকে । আত্মহত্মা হলেও তার ময়না করা হয়নি । সরাসরি শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তার সৎকার করা হয়যেটা আমার বেআইনি এবং অপারাধ মূলক একটা কাজই মনে হয়েছে । আর জানিনা, জেঠিমা তার দ্বিতীয় সন্তান শোকে কি করেছিল । দুই পরিবারের সময়ের অভাবে, নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ততার কারনে, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এখন যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন বললেই চলে । তাই এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারিনি ।

কিছুদিন আগে, মা বলল, জেঠিমাও চলে গেছে । একদিন সকাল থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না । বেলার দিকে তার ঝুলন্ত নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় ছাদের এক চিলে কোঠার ঘর থেকে । তার পর কি হয়েছে জানি না । শুধু মনে হয়েছে এই সন্তানহীন জীবন থেকে মুক্তি নিয়েছে এক মা যে তার আত্মজ আত্মজার অসময়ে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি । পার্থনা করি , যে সন্তানদের শোকে সে তার নিজের জীবনকে উপভোগ করতে পারেনি, যেন জীবনের ওপারে সে তার সেই হারানো সন্তানদের দেখা পায়, তাদের সাথে খুশি থাকে ।

এতো কথার মাঝে যার কথা বলা হল না সে হল জেঠু, শ্রী মদন চৌধুরী । সেও তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে হারিয়েছে এই ঘটনা বহুল জীবনে এই সাধারণ মানুষটার মনের খবর কেউ কোনদিন রাখেনি । হয়তো তার স্ত্রীও না । রাখলে হয়তো এভাবে শেষ বয়সে তাকে একা সঙ্গীহীন করে স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারত না । এই মানুষটা সারা জীবন চুপ চাপ নিজের কাজ করে গেছে । রাগ, দুঃখ, আভিমান, প্রতিবাদ তার জীবনে নিষ্ঠুর ভাবে আঁচড় কেটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ক্ষত তার মনকে বিষিয়ে দিতে পারেনি । চিৎকার করে বুক চাপড়ে কাঁদেনি বলেই হয়তো সবাই ধরে নিয়েছে সে ঠিক ছিল ও আছে । আর হয়তো তাই আমারও জেঠুর মুখের সেই মিষ্টি হাসি ছাড়া আজ আর কিছুই মনে পড়ে না ।      

             মৌমিতা সাহু
             ২৫/০১/২০১৬ , ব্যাঙ্গালোর


           

Saturday, 16 January 2016

কাজ

লাল মোরাম রাস্তার এপারে একতলা একটা পাকা বাড়ি, আর ওপারে একটা খড়ের ছাওয়া ঝুপড়ি ঘর । মা, বাবা আর ছোট্ট ভাই এর সাথে আমি সেই একতলার বাড়িটায় ভাড়ায় থাকতাম  আর উল্টো দিকে বৌমা তার অসুস্থ ছেলে, ছোট্ট মেয়ে আর স্বামীর সাথে থাকতো । বাবার বৌমা তাই আমি আর ভাই দুজনেরও বৌমা । শুধু মায়ের কাজলদি ।  

১৯৯৩ সাল, আমার তখন সাড়ে চার বছর বয়স, আর ভাই এক মাসের মা ভাইকে নিয়ে মামাবাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই বৌমা আমাদের ঘরে আসা শুরু করে, মা কে কাজে সাহায্য করতে। স্বামীর একার উপার্জনে সংসারের খরচ খরচা কুলিয়ে উঠত না, তাই বৌমা আর পাঁচটা বাড়ির কাজ করে কিছু বাড়তি উপার্জন করত । ধরা বাঁধা বাড়ির কাজ ছাড়াও অনেকের অনেক কাজ করে দিতো । কারো বাড়ির ধান সেদ্ধ, কারো মুড়ি ভাজা, কারো পাকা তেঁতুল ছাড়ানো, শীতের সকালে নকশা বড়ি দেওয়ার জন্য বিরি কলাই বেটে দেওয়া  কেউ কেউ পুরনো শাড়ি ধুতি দিয়ে যেত, কাঁথা বানানোর জন্য। দুর্গা পুজার আগে কারো মাটির বাড়িতে সাদা মাটি আর গোবর দিয়ে নাতা দিতো ।

আমাদের পাড়ায় একজন পুলিশ ভাড়ায় থাকতেন। থানার ওয়ারলেস অপারেটার ছিলেন।  নাম মনে নেই ।  পদবি ছিল বেদান্ত। আমাদের ছোটোদের পুলিশ জেঠু । জেঠুও বৌমাকে বৌমা বলতেন ।  বৌমা পুলিশ জেঠুর জন্য রান্না করে দিতো। রোজ একই রান্না হতো। কিছু রুটি আর সব রকম সবজি দিয়ে একটা তরকারি । বৌমার শুকনো পাতার জ্বালানীর উনুনে রুটি প্রায়ই পুড়ে যেত । সেই পোড়া রুটি খেতে জেঠু খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, রুটি পোড়া খেতেই নাকি বেশি ভালো। আর আমার ভাই, তার তো বৌমার ঘরের  শুকনো রুটি একটু গুড় বা এক চামচ ডাল আর একটু আলু মাখা দিয়ে ভাতই বেশি পছন্দ ছিল ।

এতজনের মাঝে মা আর বৌমার সম্পর্কটা একটু আলাদা ছিল ।  সব ঘরের কাজ শেষ করে বৌমা আমাদের বাড়ি আসতো । কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতো । ভাইকে সরিষার তেল মালিশ করতে করতে ছড়া কাটত  আড়ে বাড়ে লম্বে বাড়ে , সরস্বতীকে নম করে  ভাই বৌমার কোলে কোলেই বড়ো হয়েছে । সকালে বিকালে রাস্তার ধারে সরকারি টাইম কল থেকে জল তোলা, কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলত । তার পর সন্ধ্যা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের ঘরে চলে আসত  মাও আপেক্ষা করত তার কাজলদির জন্য ।  আমাদের বাড়িতে চায়ের চল ছিল না, কিন্তু মায়ের কাজলদির জন্য হত । আর সাথে শুকনো মুড়ি । মুড়িতে কখনো চানাচুর কখনো ঘিয়ের চড়া আর চিনি মেশানো থাকতো । আমি আর ভাই ও বৌমার সাথে খেতে বসে যেতাম । আর সবাই মিলে টিভিতে জন্মভুমিসিরিয়াল দেখতাম । চা খাওয়ার কাঁচের গ্লাস গুলো ধুতে গিয়ে মাঝে মধ্যে সেগুলো ভেঙে যেতো । তখন বৌমা বলতো দিদিগো, হায় তোমার একটা গ্লাস ভেঙ্গেইছে  মা বলতো সে ভাঙ্গুক, আপনার হাত কাটেনিতো ’? মা আর বৌমার মধ্যে কাজের লোক আর মালিকের তো কোন সম্পর্কই ছিল না, বরং পাড়ার অন্যান্যরা এই ভালবাসা দেখে হিংসে করত । কেউ কেউ বলতো মৌয়ের মা এর কাছে গেলে তুমি তো আসতেই চাও না কাজলদি।বৌমা সে সব কথায় খুশি হয়ে হাসত।  

বৌমার সাথে তার বাপের বাড়ি আমি ও ভাই বেশ কয়েকবার গিয়েছি । বৌমার মুখে তার ছোটবেলার গল্প অনেক শুনেছি । চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার বাড়িতে ছিল সে। বাবার খুব আদরের ছিল সে বৌমার মুখেই শুনেছি তার বাবা নাকি গুনিন ছিলেন। ঝাড় ফুঁক মন্ত্র দিয়ে ভূতকে কব্জা করতে পারতেন । ঘোড়া ভূত, গোমুখা ভুত, কুন্দ্রা ভূত, স্কন্ধ কাটা ভূত, সুপুরষা কুপুরষা, শাকচুন্নি, পেত্নী কিংবা হনুমান ভূত সব তাঁর মন্ত্র দেওয়া সরিষায় কাবু হত । ঘোড়া ভুত আসলে শুধু চিঁহি চিঁহি ডাক আর ঘোড়া খুরের তগবগ শব্দই শোনা যায়। তাকে দেখা যায় না । কুন্দ্রা ভুত হল পোষা ভুত। মনিব যা বলে সে তাই করে। স্কন্ধ কাটা ভূতের মুণ্ডু থাকে না। শুধু ধড়টাই থাকে। তাই সেই ভুত কিছু দেখতে পায়না । কিন্তু সে সব কিছু জড়িয়ে ধরতে চায় । যদি একবার কাউকে জড়িয়ে ধরে তার আর নিস্তার নেই। গোমুখা ভুত আবার খুব অদ্ভুত, সে কখনো সাদা বাছুরের রূপ নেয়, কখনো গরুর রূপ নেয়, কখনোবা গোবরের রূপ নেয়। বৌমা বলে, কেউ যদি সেই গোবর ডিঙ্গিয়েছে তার আর নিস্তার নেই ।  সব গল্প শুনে শুনে , সেই সব জায়গা দেখার খুব ইচ্ছে হতো । বৌমার বাপের বাড়ি গেলে সারা দিন পুকুর পাড়ে, মাঠের ধারে , বনে জঙ্গলে ঘুরে, পুকুরে স্নান করে , মাছ ধরা দেখে কেটে যেত । সন্ধ্যে বেলা ঘরের বাইরে পরিস্কার নিকানো উঠোনে মাদুর পেতে আমরা সবাই ছোটরা বসতাম বৌমার মায়ের চার পাশে । ভুতের গল্প শুনতে । কিন্তু দিদা বলত, আজকাল আর সেরকম ভূত এর উৎপাত নেই। ভূত আজ কাল দেখাই যায় না । কি আর করা যাবে । তাই বৌমার কাছে সেই সব গল্প ঘুরে ফিরে শুনতাম , আর দূরে মাঠের ওপারে রাতের আন্ধকারে ট্রেন ছুটে যেতে দেখতাম ।

পড়াশুনা খেলাধুলা ভুতের গল্প এই সব নিয়েই বেশ কাটছিল দিন গুলো । সালটা ২০০০ বা ২০০১ হবে । আমরা তখন একই পাড়াতে অন্য একটা বাড়িতে ভাড়ায় থাকি । বৌমা আমাদের বাড়িতে তখন আর কাজ করে না । ভাই বড়ো হয়ে গেছে । ঘরের সব কাজ মা একা সামলে নিতে পারে  কিন্তু তাতে মা আর বৌমার সম্পর্কে কোন পরিবর্তন আসেনি । ভালো মন্দ কিছু হলেই বাটি ঢাকা দিয়ে সেটা এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যেত । কাজলদি বললেই বৌমা হাজির । মা যেখানেই যাক, কারো জন্য কিছু আনুক চাই না আনুক , হাতে কাজলদির জন্য কিছু থাকবেই । ভাই বাড়িতে না থাকলে নিশ্চয়ই বৌমার ঘরে থাকতো, ওটা ওর যাকে বলে সেকেন্ড হোম।

একদিন হঠাৎ, সন্ধ্যের দিকে বৌমা মাকে খুব গালা গালি দিতে শুরু করল । সে কি ভীষণ ভাষা । তাঁর আগে বৌমাকে ওভাবে চিৎকার করতে শুনিনি । খুব শান্ত স্বভাবের ছিল । স্বামীর ওপর রাগ হলেও, মাকে এসে বলতো, ‘গাল দিয়ে কি হবে দিদি?’ সেই বৌমা যে মাকে ওভাবে গালাগাল করতে পারে তা আমাদের কল্পনার অতীত ছিল । আর মা, একটা শব্দও করলেন না । বললেন, ‘কোন কারনে মাথা খুব গরম হয়ে গেছে, তাই ওরকম বলছে, কাল মাথা ঠাণ্ডা হলে, নিজেই আসবে। এখন কিছু বললে কথায় কথা বাড়বে। না, পরের দিন বৌমা আসেনি, মাও কখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু, দুঃখের কথা বৌমার গালাগালি দেওয়া বন্ধ হল না । শুধু মাকে না, যখন তখন যাকে তাকে গালি দিতে শুরু করল । কোন কারন নেই তাও । একদিন বিকেলে পাড়ার একজনের হাতে বৌমা একটা পোস্ট কার্ড সাইজের ছবি পাঠিয়েছিল। আর বলেছিল, ‘দিদি কে দিয়ে বলবি, আমি হারিয়ে গেলে এই ছবি দেখিয়ে যেন খুঁজে আনে। সব চেয়ে অবাক ব্যাপার হল, ছবিটার পেছনে বৌমা নিজের হাতে নিজের নাম সই করে দিয়েছিল। শ্রীমতী কাজল রানা । এতিদিনেও জানতাম না যে বৌমা লিখতে পড়তে পারে । মাও অবাক হয়েছিল । ছেলে মেয়ে বড় করতে করতে, সংসারের বোঝা বইতে বইতে , মনের কষ্ট দুঃখ সেভাবে কখন প্রকাশ করতে পারেনি । এক সময়, তার শরীর আর সেই বোঝা টানতে পারছিল না । চিন্তা শক্তি, বোধ বুদ্ধি বিচার ক্ষমতা হারাচ্ছিল ধিরে ধিরে । আমার মনে হয়, রাগ, ঘৃণা সব মনে ছিল আর কাছের মানুষ হিসেবে , বন্ধু হিসেবে, যে মানুষের ছবিটা মনে আসছিল সেটা মা ছিল । মস্তিষ্ক কাজ না করায়, মায়ের ওপরেই রাগ দেখিয়েছিল সেদিন । পরে হয়তো মনেই ছিল না, যে সে এরকম কিছু বলেছিল । তাইতো সেদিন , নিজের হারিয়ে যাওয়ার অজানা আশঙ্কায়ও মাকেই তার মনে পড়েছিল, বন্ধু হিসেবে।

দুই তিন বছর এমনিই কাটল। কিছু ডাক্তার দেখানো হল । তখন বৌমা আর চিৎকার করতো না । সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বকত। কখন ব্যক্তি বিশেষ, কখনো বস্তু বিশেষ, কখনো নিজেই নিজের বিষয় বস্তু এতো কিছুর মাঝেও তার কাজ কিন্তু থামেনি। মনের ভেতর, মাথার ভেতর সব উল্টে পাল্টে গেলেও, কি কাজ কখন করতে হবে সেটা সে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। লোকজন চিনতে ভুল হত না, হিসেবে ভুল হত না , রাস্তা চিনতে ভুল হত না, এমনকি রান্নার নুন মশলাও একদম ঠিক করে দিত। তাই অনেকেই ভাবত সে এইসব জেনে বুঝেই করছে।  

আমরা নিজেরদের নতুন বাড়িতে চলে এসেছিলাম । পুরনো পাড়া থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে । মা সব সময় তার কাজলদির খোঁজ রাখত । দেখা নেই কথা নেই তাও খোঁজ ঠিকই রাখত । মা কখনো বোধ হয় বৌমার ওপর রাগই করেনি । একদিন বিকেলে হঠাৎ বৌমা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির । কিছুক্ষণ বসল , দিদি দিদি করে গল্প করল । চা খেল, আপন মনে কথা বলল কিছুক্ষণ। কিছু জিজ্ঞেস করলে কোন কথার সঠিক জবাব দেয়, কোন কথার দেয় না। কোন প্রসঙ্গ থেকে কোথায় চলে যায় এক মুহূর্তে বোঝার উপায় নেই । তার পর চলে গেল । সে দিনের পর থেকে বৌমা মাঝে মাঝেই আসে । কখনো কখনো খাওয়ার নিয়েও আসে ।

আজকাল বৌমা আর তেমন বকবক করে না । অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে । বয়স হয়ে গেছে । কোমরটা একটু বাঁকার দিকে । রোগা হয়েছে । শরীর আর কাজের বোঝা বইতে পারছে না। তাও কাজ করে চলে । ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, এ কাজ, সে কাজ। রাস্তার ওপারের একতলা বাড়িটা এখন চার তলা হয়েছে ।  এখনও সেই বাড়ির, কারো কারো টুকি টাকি কাজ করে দেয় বৌমা বৌমার বাড়ি  যাওয়া হয়না অনেক দিন। শেষ বার যখন বাড়ি গেলাম, পুজার সময়, বৌমা একবার দুধ পিঠা, একবার লুচি মাংস করে নিজে দিতে এসেছিল । এসেই চলে গেল । সেবার গেলাম বৌমার ঘরে একদিন আমি আর ভাই গিয়ে দেখলাম, বাঁশের বেড়ার জায়গায় ইটের তৈরি দেওয়ালের ঘরে সে থাকে বটে, কিন্ত, তাতে তার নিজের অবস্থার পরিবর্তন হ্য়নি বিন্দুমাত্র । তেইশ বছর আগেও যা ছিল , আজও তাই আছে ।

হাসি মুখে জীবনের দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেল একদিন, রাগে দুঃখে আভিমানে গালাগালি দিয়ে সেই দুঃখকে তাড়াতেও চেয়েছিল, কিন্তু হায় পারেনি সে। দুঃখ হার মানেনি যে , ছেড়েও যায়নি তাকে। তাই বুঝি আজ সে এত শান্ত । দুঃখের সাথে পাশাপাশি থাকে, হাসে না কাঁদে না, মান নেই আভিমান নেই। এখন বুঝি বেঁচে থাকাটাও তার কাছে একটা কাজ । তাই মুখ বুজে সেই কাজ করে চলেছে সে।         

            -Moumita Sahu