আমার বাবা জন্ম
সুত্রে হিন্দু, আর সিদ্দিক কাকু মুসলিম । সিদ্দিক কাকু, পুরো নাম আবু বক্কর
সিদ্দিকি, আমার বাবার বন্ধু। বাবার সিদ্দিক, মা এর সিদ্দিকদা, আর আমার সিদ্দিক
কাকু । কাকু মারা গেছেন ২০০৫ সালে । তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধুত্য ছিল । কিভাবে,
কবে, কখন যে দুজনের দেখা হয়েছিলো, আর কিভাবেই যে বন্ধুত্য হয়েছিলো তা আমি জানি না
। জানার সেভাবে চেষ্টাও করিনি।
আমার ছোট বেলার
স্মৃতি যেখানে শেষ হয় সেখানেও সিদ্দিক কাকুর আঁকা ছবি গুলো আছে। ঘরের দেওয়ালে
টাঙ্গানো কাকুর আঁকা সব ছবি। সবই ল্যান্ডস্কেপ। ফাঁকা সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে লাল
ট্রেন ছুটে চলেছে, কোথাও বা নদীর ধারে সবুজ ঘাসে এক পাল গরু চরছে, কোথাও বা নীল
পাহাড়ের তলায় হরিণ শিশুর দল । দুরে থাকলে মা বাবা কে খুব চিঠি লিখতেন কাকু। সব
পোস্ট কার্ড এ । আর প্রতিটা পোস্ট কার্ড এর পেছনের ছোট্ট জায়গায় সুন্দর সুন্দর
রঙিন ছবি আঁকতেন । কোনটায় একটা লাল গোলাপের সাথে একটা কুঁড়ি আর কিছু পাতা , কোনটায়
একটা ফুলদানি তে অনেক তাজা রঙিন ফুল , আবার কোনটায় তিন চারটা নাম না জানা বুনো
ফুল। আমার সব চেয়ে ভালো লাগত একটা ডালে দুটো পাখি মুখমুখি বসে আছে। এখন মনে হয় কাকু বোধ হয় কাকিমাকে মনে করে আঁকতেন। কারন, কাকুর ডাক নাম ছিল বুলবুল
আর কাকিমার ময়না।
আমাদের বাড়িতে কাকুর
একটা অনেক পুরনো ছবি ছিল। সাদা কালো, বুক পর্যন্ত ছবিটা । কাকুর মুখ ভরতি কালো দাড়ি, কালো কুছ কছে লম্বা লম্বা চুল । সুন্দর দুটো চোখ,
টিকলো নাক। পরনে সাদা পাঞ্জাবি । ছোট বেলার মনে হতো, কাজী
নজরুল ইসলাম । কিন্তু, সিদ্দিক কাকু আমারদের বাড়িতে আসতেন, দাড়ি গোঁফ কেটে , চোখে
মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে । আমাকে পাশে বসিয়ে পোস্ট কার্ডে ছবি আঁকতেন । আমি
দেখতাম কি করে কাকু অমন সুন্দর জ্যান্ত গোলাপ আঁকেন । দেখে দেখেই একদিন শিখে
নিলাম, আর কাকুকে এঁকে দেখালাম। কি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন তিনি । বলেছিলেন, তুই পারবি
। নাহ, আমার আর পারা হয়নি ।
মায়ের হাতে রান্না
খেতে খুব ভালবাসতেন । মাকে ডাকতেন স্মৃতি বলে । খড় ছাতু খাওয়ার জন্য খুব বায়না
করতেন। মা দিতে চাইতেন না, মুসলিমদের খেতে মানা তাই। উনি শুনতেন না । ছেলে মানুষের মতো খাওয়ার জন্য বায়না করতেন । খাওয়ার পর খুশি
হয়ে বলতেন, “বেশ ভালোই খেতে স্মৃতি, তুই কেন আমাকে দিচ্ছিলি না।” চশমা ছাড়া মাছ
খেতে পারতেন না। মাছের কাঁটা দেখতে পেতেন না । ব্লাড সুগার ছিল তাই বাবাকে লুকিয়ে
মিষ্টি দই খেতেন । দুপুরে খাওয়ার পর আমাকে শুয়ে শুয়ে গান শোনাতেন । ‘ও আমার ছোট্ট
পাখি চন্দনা’ , ‘ও তোতা পাখিরে’ , ‘কি গান শোনাবো বলো ওগো সুচরিতা’ আরও কতো কি। গানের
সুরে ভুল হলে আবার গোড়া থেকে গাইতেন । আমার সব চেয়ে পছন্দের গান ছিলো ‘কি গান
শোনাবো বলো ওগো সুচরিতা’ । আজও আমার সব চেয়ে প্রিয় গান। পুরটা গাইতে পারি । সব
চেয়ে সুন্দর করে ।
সিদ্দিক কাকুকে নমাজ পড়তে বা মসজিদে যেতে দেখিনি কখনো। তাই আল্লা বা ভগবানে তাঁর
বিশ্বাস ছিল কিনা জানি না। তবে কোন মানুষকেই তিনি খারাপ ভাবতে পারতেন না । বিভিন্ন
জায়গায় থেকে বিভিন্ন রকম কাজ করতেন । আর মা কে এসে গল্প শোনাতেন । কোথায় তাকে অবহেলা
করা হয়েছে, কোথায় অবজ্ঞা , কোথাও বা পাশে বসিয়ে খাওয়ানো হয়েছে মালিকের সাথে কিন্তু
খাবারের পার্থক্য ছিল চোখে পরার মতো , আবার কেউবা ভালবেসেছে অকারনে । এই সব কথাই তিনি মাকে শোনাতেন অবলীলায়, হাসি মুখে। মায়ের কষ্ট হতো, রাগ হতো । তিনি কিন্তু রাগ করতেন না । গান গাইতেন । মা যদি জিজ্ঞেস করত, ‘ঐ মানুষটা কেমন
সিদ্দিকদা ? ’ উনি বলতেন, “কেন ! ভালোই তো ! আমিতো কিছু খারাপ দেখি না।”
সারাজীবন বাইরে
বাইরে ঘুরে ঘুরে কাজ করেছেন । ছেলেদের বড়ো হয়ে ওঠা, নিজের বাবার মৃত্যু , স্ত্রীর
সাথে সময় কাটানো কিছুই তাঁর হয়ে ওঠেনি । যদিও আমার মনে হয়, তিনি কাউকেই আলাদা করে
ভালবাসতে পারতেন না । তাঁর চোখে সবাই সমান ছিল। আমি যখন ক্লাস থ্রি
তে পড়ি তখন কাকু বাড়ি চলে গেলেন । জেলা বীরভূম, গ্রাম বুজুং । এক রকম পাকা পাকি
ভাবেই । তার পর তিনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন একবার আমি তখন ক্লাস ফাইভ এ। আর শেষ বার
তাঁকে দেখি তখন আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, ২০০০ সাল। ২০০২ সালে ভয়াবহ
বন্যা হয়েছিলো বীরভূমে । বড় বড় পাকা রাস্তা ভেসে গিয়েছিল । যোগাযোগ
পুরপুরি ভাবে বিচ্ছিন্ন । খবরে শোনা মাত্র বাবা বেরিয়ে পরেছিলেন । আমরা থাকি
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় । খবরে মৃতের সংখ্যা ছাড়া কিছুই জানা যাচ্ছিলো না ।
বহরমপুর ষ্টেশানে নেমে বাস ধরে বাবা পৌঁছেছিলেন কিছুদূর । সেখান থেকে আর যাওয়ার
উপায় ছিল না । কেউ কেউ বলেছিল বুজুং যাবেন না । সেখানে আর কেউ বেঁচে নেই । তাও
বাবা গেছিলেন সেদিন। মাথায় ব্যাগ নিয়ে, কোথাও এক কোমর, কোথাও এক বুক জল পেরিয়ে।
কোথাও হেঁটে, কোথাও ভ্যান রিক্সায়। কোন ঠিক নেই, যাদের কাছে যাচ্ছেন তাঁরা আদউ
জীবিত কিনা। মনের জোর আর বিশ্বাসে ভর করে , ভালবাসার টানে, বন্ধুতের টানে সেদিন
পৌঁছেছিলেন। সবাই জীবিত ও সুস্থ ছিলেন । আমি না দেখলেও, আন্দাজ করি , সেদিন দুজন
দুজন কে জড়িয়ে ধরে হেসেছিলেন ও কেঁদেছিলেন । এমন বন্ধু আমি হয়তো হতে পারব না কোন
দিন ।
বাড়ি যাওয়ার পর থেকে
কাকু আঁকায় মন দেন । ৪১ টা ছবি তৈরি ছিল, তাঁর জীবনের প্রথম প্রদর্শনীর জন্য । সব
ছবি বন্যার জলে নষ্ট হয়ে যায় । জীবনটা
বেঁচে গেলেও, প্রানটা হারিয়ে যায় । এতো বড়ো আঘাত মানিয়ে নিতে পারেনি । মেজাজ
খিটখিটে হতে থাকে । ব্লাড প্রেসার, ব্লাড সুগার তরতর করে বাড়তে থাকায়, চোখের
দৃষ্টি দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। তারি মধ্যে একদিন সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ডান হাতটা
ভেঙ্গে যায় । সে হাত কোন দিনই আর পুরপুরি ঠিক হয়নি। সেই সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে
তাঁর আশা ভারসা চলে যেতে থাকে । মন ভেঙ্গে যেতে থাকে শরীরের সাথে সাথে। যে শিল্পীর
রং চেনার চোখ থাকে না, তুলি ধরার হাত থাকে না, শুধু চারপাশে ছড়িয়ে থাকে পুরনো রঙের
শিশি, ভাঙা তুলি, বন্যার জলে পচে যাওয়া রঙিন ক্যানভাসের স্তুপ, সে শিল্পীর মন
বোধকরি রোজ ভগবানের কাছে, আল্লার কাছে এমন জীবনের থেকে মুক্তি চাইত, নতুন এক আলোর আশায়।
এমনি করেই চলে গেলেন এক দিন, আমাদের সকলকে
ছেড়ে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে মায়ের সাথে খাচ্ছিলাম । খবর আশা মাত্র , মা আর খেতে
দিলেন না । সব কিছু ফেলে দিলেন । হিন্দু ধর্ম মতে কেউ মারা গেলে , তার আগের রান্না
করা খাবার খাওয়া হয় না । কিন্তু তিনি তো মুসলিম ছিলেন । সেদিন বুঝেছিলাম, ভালবাসার
কোন জাত হয় না । বন্ধুত্যের কোন ধর্ম হয় না । তিনি ছিলেন আমাদের সকলের আত্মার
আত্মীয় । পরিবারের সদস্য । বাবা গেছিলেন তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে। শেষ মুহূর্ত
পর্যন্ত ছিলেন তাঁর পাশে । আমি আজও বিদায় জানাতে পারিনি । প্রায়ই মনে পড়ে সিদ্দিক
কাকু । চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর আঁকা ছবিগুলো, শুনতে পাই সেই মিষ্টি সুরেলা গান,
মাঝে মাঝেই আমার সাথে খুনসুটি করেন। পৌঁছে যাই সেই দশ বছর বয়সের এক বিকেল বেলায়।
শীতের বিকেলে, সূর্য অস্তগামী, কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে । দোতলার বারান্দায় গ্রিল
ধরে দাঁড়িয়ে দেখি সিদ্দিক কাকু সাইকেলে উঠে পড়েছেন, একটু একটু করে দূরে চলে
যাচ্ছেন । কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে, আর দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। তাও তাকিয়ে থাকি সেই পথের
দিকে ।
- Moumita sahu
- Moumita sahu