Sunday, 28 February 2016

মোতি

গরম কাল আমার বরাবরই পছন্দের কাল। শীত আমার কখনই ভালো লাগে না । এই ভাললাগা না লাগার অনেক কারন। শীতের রকমারি ফুল ফল সবজি যতই হোক, তার চেয়ে গ্রীষ্মের দুপুরের গরম বাতাসে ভেসে আসা আমের মুকুলের গন্ধ আমার বেশি প্রিয় । কনকনে ঠাণ্ডায় উষ্ণ জলে স্নানের চেয়ে, ভীষণ গরমে ঠাণ্ডা জলে স্নান ঢের বেশি আরামের । শীতকালে ভোর হয় দেরিতে , সন্ধ্যে হয় তাড়াতাড়ি । ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগে না আমার । ভরা গরমে সকাল স্কুল থেকে ফিরে , দুপুরে লম্বা ঘুম, তার পর বিকেলে সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো , কখনো ক্রিকেট খেলা । আরও কতো কি । গরমে ঘামে ভেজা গায়ে টেবিল ফ্যানের সামনে বসে হাওয়া খাওয়ার মতো আরামের আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না । তাছাড়া আমার সব চেয়ে প্রিয় বিকেল শেষে হঠাৎ কালবৈশাখী । এই সবই পাই গরম কালে । মনে পড়ে এমনি কোন গরমের সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে মাদুরে বসে হারিকেনের সামনে পড়তে বসা । ছোট থেকে বড় হয়ে উঠতে উঠতে এরকম হাজারো ভাললাগার স্মৃতি জমে উঠেছে আমার মনের মণিকোঠায় । সেগুলো একদিন গুছিয়ে বলবো । সেদিক থেকে শীতের স্মৃতি বেশ কম । বেশি কিছু মনেই পড়ে না । শীত বললেই মনে হয় লেপ ছেড়ে বেরনোর কষ্ট, স্নান করে সুখ নেই, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, সারাক্ষণ সোয়েটার টুপি পরে থাকা আর রাতে খাওয়ার পর গরম উনুনের সামনে বসে হাত পা সেঁকা যা কিনা পাঁচ মিনিটে ঠাণ্ডা হয়ে যায় । আসলে ভালো না লাগলে, মনে কোন জিনিসই থাকে না। তাইতো মানুষ , অনেক টাটকা কষ্টের স্মৃতি ভুলে , তার চেয়েও পুরনো সুখের স্মৃতি মনে করে সুখে দিন কাটাতে পারে । তবে আজ আমি এক শীতের সন্ধ্যার একটা সুখের স্মৃতির কথা বলব।

সময়টা শীতের শুরুর দিকে । কোন এক রবিবারের দুপুর । তখনও আমি সাইকেল চালাতে শিখিনি । সেলুনে চুল কেটে বাবার সাইকেলের পেছনে আমি আর সামনে ভাই বসে বাড়ি ফিরছি । গ্রামের মোরাম রাস্তা ধরে বাবা ধিরে ধিরে সাইকেল চালাচ্ছেন। গ্রামের রাস্তা সাধারণত আঁকাবাঁকা হয় । সেই সব রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময় আমি মোড় গুনতাম । পোস্ট আফিস, তার পর রেশন দোকান , তার পর ঝাড়ারবাড়ি , তারপরের মোড়ে একদিকে আমাদের বাড়ি অন্য দিকে কুমড়িদের বাড়ি । এই রেশন দোকান আর ঝাড়ার বাড়ির মাজে একটা পাড়া পড়ে । সেই পাড়ার পরে নাম হয়েছিল ‘নেতাজী সুভাষ পল্লী’ । তবে আমি যখনকার কথা বলছি তখন কোন বিশেষ নাম ছিল না । আমরা যখন সেই পাড়ার কাছাকাছি এসেছি, হঠাৎ দেখি একটা ছোট্ট সাদা বলের মতো কুকুর ছানা থুপ থুপ করে গলির রাস্তায় ঢুকছে । পাড়ার প্রথম আর দ্বিতীয় বাড়ির মাঝে সে যোগ দিল তার মা আর ভাই বোনদের সাথে । বাবা সাইকেলটা আরও ধিরে করে একটু পা লাগিয়ে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ । আমি বললাম ‘বাবা ওটাকে নিয়ে যাব ?’ বাবা বললেন ‘না না, কারও বাড়ির পোষা এরা , দেবে কেন !’ মনটা খারাপ হয়ে গেল । বাড়িতে ফিরে মাকে কুকুর ছানার গল্প শোনালাম । সেই গল্পের প্রথম অধ্যায় হাসি মুখে আর শেষ অধ্যায় দুঃখী মুখে শুনিয়েছিলাম । বিকেলে হঠাৎ দেখি বাবা সেই সাদা তুলতুলে নরম বলের মতো কুকুর ছানাটাকে বাড়ি এনেছেন । সবার কি মজা । মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল কিন্তু আমাদের খুশিতে না খুশি হয়ে পারল না । যাদের কুকুর তাদের বাড়ি গিয়ে বাবা আমার জন্য নিয়ে এলেন । তারা খুশি হয়েই দিয়েছিল । দেশি কুকুর বলে খুব বেশি আদর ছিল না তাদের বাড়িতে। তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না । তখন আমাদের খুশির সীমা ছিল না । নতুন অতিথির জন্য বিশেষ ধরনের নতুন সাবান , পাওডার এলো । একটা কাঠের বাক্স এল , তাতে খড় বিছিয়ে পুরনো কাপড় দেওয়া হল । শীত কাল ঠাণ্ডা না লেগে যায় । সেটাতে তার ঘুমনোর ব্যাবস্থা । ঘরের কোনায় তার বিছানা্টা রাখা হল । পরের দিন চেন কেনা হল । ঠিক সময় করে তাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হত । কিছু দিনের মধ্যে তাকে ভেটেনারি ডাক্তারের পরামর্শে  ইঞ্জেকশানও লাগানো হয়েছিল । তবে এসবের আগে যেটা হয়েছিল , সেটা হল নামকরণ । বাড়িতে নতুন আতিথি , তার নামকরণ হওয়া সব চেয়ে জরুরি ছিল । অনেক ভেবে বাবা নাম রাখলেন , ‘মোতি’ । আর সেদিন থেকে মোতি আমাদের পরিবারের এক সদস্য হয়ে গিয়েছিল ।

মোতি আসার দুই সপ্তাহ হয়েছে। এখন তাকে বাড়ি সামনের প্রাচীর ঘেরা খোলা জায়গায় খেলার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় । সঙ্গে কেউ থাকে যেন সে রাস্তার দিকে চলে না যায় । ছোট্ট মোতি না বুঝে রাস্তায় চলে গেলে গাড়ি চাপা পড়তে পারে । নিদেন পক্ষে সাইকেলে ধাক্কা তো দেবেই । তাই তার পাহারায় কেউ না কেউ থাকেই । এতো সতর্কতার মধ্যেও সেদিন মোতি হারিয়ে গেল । বাড়ির আসে পাশে , পুরো পাড়া সব খুঁজে ফেলা হল । কিন্তু মোতিকে পাওয়া গেল না । চোখ ফেটে জল এলো । কান্না কিছুতেই থামে না আমার । তারই মধ্যে কেউ বলল , নদীর দিকে যাওয়ার রাস্তায় একটা ছোট্ট ছেলে একটা সাদা কুকুর নিয়ে যাচ্ছিল, যার গায়ে কালো ছোপ ও ছিল । কিন্তু তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে । শীত কালের বেলা, এমনিতেই ছোট । সেই অন্ধকারে নদীর রাস্তায় যাওয়া সম্ভব ছিল না । বাড়িতে মা আমি আর ভাই । বাবা তখনও ফেরেননি । আমরা বাবা আশার আপেক্ষা করতে লাগলাম । মা আমাদের পড়তে বসিয়ে দিলেন । কিছুক্ষণ পর পড়াতে দাদা (মাস্টার মশাই) এলো । পড়ায় কিছুতেই মন বসছিল না । বার বার খালি কাঠের বাক্সটার দিকে তাকাচ্ছিলাম । কান্না আসছিল । রাত আটটার দিকে বাবা বাড়ি ফিরলেন । কাঁদো কাঁদো মুখে আমি বাবাকে বললাম , বাবা, মোতি হারিয়ে গেছে । মা বলল , কোন বাচ্চা নিয়ে চলে গেছে । সঙ্গে সঙ্গে বাবা বেরিয়ে গেলেন সাইকেল নিয়ে । বাবা যখন ফিরলেন তখন রাত প্রায় দশটা বাজে । আমি খুব আশা করেছিলাম, বাবা মোতিকে ঠিক খুঁজে আনবেন । সাইকেলের শব্দ শুনে, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম । প্রথম প্রশ্ন , বাবা মোতি কোথায় ? বাবা বললেন , অনেক খুঁজেও মোতির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি । কাল আর একবার খুঁজতে যাবেন । মনে হল বাবা মজা করছেন । বাবার আসে পাশে , পেছনে গিয়ে দেখলাম। মনে হল মোতি এসেছে, বাবা কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন । কিন্তু, হতাশ হলাম খুঁজে না পেয়ে । প্রায় মেনে নিচ্ছিলাম যে মোতি ফেরেনি, এমন সময় আমার চোখ গেল বাবার পেটের দিকে । বাবার পেটটা একটু বেশি মোটা লাগছে না ! সন্দেহ আর থাকলো না যখন দেখলাম, মোতির ছোট্ট ছোট্ট পা গুলো বাবার শীতের কোটের তলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে । সঙ্গে সঙ্গে বাবার কোটের জিপটা টেনে খুলে ফেললাম , আর মোতি মাটিতে নেমে কুই কুই করতে লাগলো । কোটের ভেতর সে বেশ আরামেই ছিল । মাটিতে নেমে সে ঠাণ্ডা বোধ করছিল । বাড়িতে খুশির ধুম পড়ে গেল । মোতি এসে গেছে , এখন তাকে নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাচ্ছে না । আমি তাকে তুলে কাঠের বাক্সে শুইয়ে দিলাম । সবাই ব্যাস্ত এই জানতে যে , বাবা তাকে পেলেন কোথায় । বাবা শোনালেন আর এক গল্প । আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে, নদীর ওপারে একটা ছোট্ট বাজার মতো আছে , শীতের রাত বলে প্রায় সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে । এক দুটো দোকানে   জিজ্ঞেস করে তেমন কিছু জানা গেল না । তারি মধ্যে কেউ বলেছিল, সামনে মুসলমান বসতি , সেখানের কোন বাচ্চা নিয়েও আসতে পারে । এদিক সেদিক খুঁজেও যখন তিনিও আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তখন এক মুসলমান ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “কুকুর ছানা? আমার ছেলে একটা সাদা কুকুর আজ বিকেলে কত্থেকে এনেছে , বলল কুড়িয়ে পেয়েছে । আপনি দাঁড়ান আমি নিয়ে আসছি ।” ভদ্রলোক কুকুরের সাথে তাঁর ছেলে কেও নিয়ে এলেন আর তাকে মারতে শুরু করলেন । বাবা কোন রকমে তাকে থামিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন ‘না মারলে আবার কারো বাড়ির জিনিস নিয়ে আসবে , না বলে’ । সে শীতের সন্ধ্যার কথা আজও আমার মনে পড়ে ।

এর পর মোতি বড় হল । বেশ সুন্দরি ছিল সে । গায়ের লোম মসৃণ  চকচকে ছিল । মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে থাকত সে । তাকে আর চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো না । সে ঘরের আসে পাশেই থাকতো । দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাত । খাওয়ার সময় খেত । মা বলত, ‘যেমন বাড়ির তেমন কুকুর । এ বাড়ির সবাই অলস’ । এর মধ্যে সে আমাকে একবার ভয় পেয়ে কামড়েও ছিল । প্রতি বছর মোতির ছোট ছোট ছানা হত । তাদের অনেকেই নিয়ে যেত । আমাদের সাথে হোলি খেলত, আর রং মেখে ফটোও তুলত মোতি । প্রায় নয় বছর আমাদের পরিবারের একজন হয়ে ছিল সে । তখন আমি হস্টেলে চলে গেছি । একদিন সন্ধ্যায় মায়ের সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম , তখন মা জানিয়েছিল মোতি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । হু হু করে কেঁদে ছিলাম সেদিন । মনে হচ্ছিল আমি আমার কতো প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলেছি , বাড়ি ফিরে যাকে আর কোন দিন দেখতে পাবো না । বাড়ির গেট থেকে আমাকে লেজ নেড়ে সে ভেতরে নিয়ে যাবে না , বাস স্ট্যান্ডে ছাড়তে আসবে না , শান্ত দু চোখ মেলে সব কথা বুঝে যাবে না । বাইরের বিড়াল ঘরে এলে তাকে না তাড়িয়ে, অলস ভাবে শুয়ে থাকার জন্য মা আর কাউকে বকবে না । আমাদের বাড়িতে মোতি বলে আর কাউকে ডাকা হবে না । আর ভুল করে ডাকলেও কেউ চুপ চুপ এসে পেছনে দাঁড়াবে না । মা আভিমানে বলবে না ‘সাড়া দিতে পারছিস না !’ । সে যে অনেক দুরে চলে গেছে, যতই কষ্ট হোক, বাবা এবার আর কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না ।
        
 Moumita Sahu
29/02/2016, Bangalore